পৃথিবীর সব মা কী তবে এক?
ড. ফেরদৌস পনি
প্রথম বর্ষেই বিবাহিত এক ছাত্রীর প্রতি আমরা শিক্ষকরা একবার খুব বিরক্ত হয়েছিলাম যখন তার অবিদ্যালয়িক পাঠ গ্রহণের সাথে সাথে পরীক্ষা কার্যক্রমকেও দীর্ঘায়িত করতে হলো ‘অসময়-মা’ হওয়ার ঘটনায়। শিক্ষার্থীদের বিয়ে, বাচ্চা-কাচ্চা প্রায়শই একাডেমিক জটিলতা সৃষ্টি করলেও বৃহৎ বিদ্যায়তনগুলোতে শেষ পর্যন্ত তা মানবতায় সুরাহা হয়।
অনেকদিন পর সেই ছাত্রীকে গবেষণাগারে কাছাকাছি পেলাম ওর থিসিসের প্রয়োজনে, চার সহপাঠী ল্যাবমেটের মধ্যে ওর সিজিপিএ কিছুটা বেশি শুনে আমার সেদিনের বিরক্তি প্রশমিত হলো। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মেয়েটির চলা-বলা যেন প্রাণহীন, সহপাঠীদের থেকে আলাদা করে ওকে ম্রিয়মান লাগলো; দিন দিনই মনে হয় ন্যাপথালিনের বলের মত উবে ছোট হয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। অথচ ফাঁক পেলেই বই একটা খুলে কী দেখে, ঠিক সাহস করে পড়েও না, যেন হাতড়ে বেড়ায় কোন যন্ত্র যা দেবে নিমিষেই অফুরান শক্তি।
থিসিসের কাজ বোঝার সুবিধার্থে কয়েকটা গবেষণা প্রবন্ধ পড়তে দিয়েছিলাম, বলাই বাহুল্য; ল্যাবের কায়িক-কর্ম রোবটিকভাবে করলেও গবেষণার গো বা এষণা তথৈবচ। তারপর থিসিস লেখা প্রসঙ্গ আসতেই ওকে ফ্যাকাশে দেখালো মুহূর্তে। একটু খটকা লাগলো, আর্থিক অসঙ্গতি বা কম্পিউটার না থাকাটা এই ডিজিটাল সময়েও এত ভড়কে যাবার কারণ হতেই পারে না। ক্রমে জানা গেলো আমাদের অধিক-আলাপিত প্রথম বর্ষের সেই ‘শুভ-বিবাহের’ শুভ ‘উড়িয়া গিয়াছে’।
বিবাহ নামক বাকি শব্দটা ওকে চির অব্যাহতি দিয়ে দাঁড় করিয়েছে ধূ-ধূ সিথের এক বালুময় মাঠে; সঙ্গী একটি শিশু সন্তান যার আপাত রক্ত-মাংসের বিকাশ করতে হবে নিজের রক্তাল্প দেহে। আস্তে আস্তে আমার কাছে দৃশ্যমান হলো অফুরান দম শক্তির খোঁজে হাতড়ে চলা সেই যন্ত্র আসলে একটি ‘জব সল্যুশন’; এই বন্ধুর-মেঘমেদূর পথে ওর আরেক সঙ্গী।
হ্যাঁ, একটি কর্মসংস্থানই পারে এই ছাত্রী-মায়ের আর্থিক, সামাজিক সমস্যায় কতকটা সহায় হতে। কারণ আইনি লড়াইয়ে অক্ষম এই অপরিপক্ক মায়ের দ্বীন পরিবার ফিরে পায়নি তাদের নিঙড়ে দেয়া ‘সুখ যাত্রার উপঢৌকন’। আদায় করতে পারেনি বিবাহ-খেসারত এমনকি সন্তানের খোরপোষ যা তার সক্ষম আইনি অভিভাবকের অতি অবশ্য প্রদেয় ছিল। বরং বিচ্ছেদের এক সপ্তাহ পরে পুনঃ অনুষ্ঠেয় মধুবাসর আপদহীন করতে সন্তানকে একটি জ্যামিতীয় ফর্মুলায় ফেলেছেন এই পিতৃদেব। ‘সন্তানের মুখ কোনদিন দেখতে পারবে না’ এই শর্তের সাথে সওদা করার মতো কিছুই নেই একজন প্রকৃত মায়ের, সেখানে খোরাকিতো অতি তুচ্ছ।
এই দারুণ সত্যটি বুঝতে পেরেই তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন; খালাস পেয়েছেন অভিভাবকত্বের জটিলতা থেকে, খোরাকিও দিতে হলো না কারণ মা মেয়ের মুখ দেখতে চায়। সালিসি বৈঠকের এ জুলুমি রায় চুপচাপ মেনে নিল অভাগি মা। তাছাড়া যে দেশে নারী সংক্রান্ত বেশিরভাগ মামলাই হয় স্থগিত থাকে, নতুবা দীর্ঘসূত্রতা আর আপসরফাতেই অস্ত যায়, দরিদ্র নারী হলে তো কথাই নেই। সেখানে থ মেরে গেলাম শুনে! হায়রে বাবা; বায়োলজিক্যাল পেরেন্টই বটে! অনেকটা উদ্ভিদের মতো, নারচার করতে পারে না।
অথচ গত বছর নেপালে ঘটে যাওয়া “কাঠমুন্ডু ট্র্যাজেডিতে” নিহত আলোকচিত্রী প্রিয়কও একজন বাবা, যিনি নিশ্বাস নিতে বাহিরে এসে জীবন ফিরে পেয়েও মৃত্যুকূপ জ্বলন্ত প্লেনের ভেতরে আবার ঢুকেছিলেন শুধু প্রিয় সন্তান ‘প্রিয়ন্ময়ী’কে খুঁজতে। সন্তানের জন্য আত্মাহুতি দেয়া বাবার সংখ্যাও কম নয় আমাদের সমাজে। তাই তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ স্যালুট জানিয়েই লিখছি আরেক দুর্ভাগা সন্তানের দুঃখগাথা। যার নরম হাতে সদ্য তোলা পেন্সিলের গ্রাফাইট বার বার ভেঙ্গে যায় কিছু একটা লিখতে; ব তে বাবা লেখা হয় না আমার ছাত্রী ছায়া'র (ছদ্ম নাম) ছোট্ট শিশুটির।
ছেলেবেলায় দেখেছি ভেঙ্গে যাওয়া সংসারের টুকরো কাঁচের মতো বিক্ষত করেছে আমার এক আত্মীয়াকে। নিজের দায়িত্বে রাখলে সন্তানই নাকি হতো মায়ের দিকে চালানো শোধ চাকায় দলি। বাচ্চাটাকে পানিতে ডুবিয়ে মেরে মায়ের অভিভাবকত্বগিরির তেরোটা বাজানোর চেষ্টাও হয়েছিল মধ্যযুগীয় এযুগে। সত্যিইতো, মামলা করার সাহস তো ক্ষমাযোগ্য অপরাধ নয় একটি দরিদ্র মেয়ের!
তাই সন্তানের বেঁচে থাকাটা নিশ্চিন্ত করতেই তিনি ‘বুকের মানিককে’ দিয়ে দিয়েছিলেন বুকে পাথর জড়িয়ে। এ যেন তরবারী দিয়ে দু’ভাগ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে গল্পের সেই আসল মায়ের আকুতি। রাতের আঁধার সাঁতরে মেয়েকে দেখতে যেতো পাগলপ্রায় সেই মা ওই ভয়াল গারদে, যা ভেঙ্গে একসময় পালিয়ে এসেছিলো বাঁচতে-বাঁচতে। তবু শেষ রক্ষা হলো না তার। দুই বছরের শিশুটি পিতৃগৃহেই হয়েছে অবজ্ঞা আর অত্যাচারে বলী। চরম প্রতিশোধ হয়েছে সেই মায়ের।
ছায়ার জীবন-বয়ান শুনে আমার মনে পড়ে গেলো কাছে-পিঠের সেই অসহ জীবন-নাট্য। তাই ওকে বললাম: “মেয়েকে নিজের জিম্মায় রেখে খুব ভালো করেছো তুমি”। রোজ সন্তানকে ছুঁতে পারে না হলবাসীনি এই মা, তবু যখন ইচ্ছে চলে যায় মেয়ের কাছে, যাকে এনে রেখেছে জীর্ণ বিধবা মায়ের কাছে, ওকে বাল্যবিয়ে দিয়েও যে-মা এখনো কন্যাদায়গ্রস্ত। এবার কন্যাজাত কন্যা; আরো বার্ধক্যবোঝা এক নিঃসম্বল পৌঢ়ার! ‘বিয়ের পরই মা না হলে অথবা বাচ্চাকে দিয়ে দিলে এত দুর্বহ দিন কাটাতে হতো না ছায়াকে’- বলে সমব্যথী হয় অনেক সহপাঠী।
এই অনভিপ্রেত নতুন ‘স্বাগতা’ হয়নি কারো কাছেই। তবু একটু একটু করে ছায়া আজ একজন পরিণত মা। মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে ওর ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত দেহে স্বস্তির হাওয়া বয়ে যায় তা আমি দেখেছি অনেকবার। হায়রে সন্তান! কত প্রাপ্তি-পূর্ণতা, পৌরুষ-নারীত্বে, কত প্রয়োজন জীব-জীবনের। অথচ আজন্ম আরাধ্য এই সন্তানকে ঘিরেই নাকি সূচনা যত অশুভের অথবা ছায়ার নির্বিশ-কায়া কিংবা ওর মায়ের আরেক খণ্ড জমি না থাকা, যা কিছু কারণ, নাকি অকারণ এই খান-খান ভাঙ্গন! সোনার খাঁচা হারানো বা মাড়িয়ে দেয়ার এমন ঘটনা যদিও আবেগহীন-আটপৌরে হয়ে গেছে আমাদের চারপাশে।
জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত ‘শিকল’ নাটকে বিপাশা হায়াৎ দেখিয়েছেন এক নিগূঢ় বাস্তবতা; ক্লান্তিকর সিঙ্গেল পেরেন্টিং কারো কারো জন্য যুদ্ধের ময়দান। আমরা কী করে বুঝবো ছায়াদের এই বিরাট বেদন! অনেক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টে আমার চোখ আটকে গিয়েছিলো: “পাগলীটি মা হয়েছে, বাবা হয়নি কেউই”।
চাপাইনবাবগঞ্জের শিবচর উপজেলায় রাস্তার পাশে একুশের (২০১৮) প্রথম প্রহরে ‘সালমা পাগলী’ জন্ম দেয় ভাষাকন্যা-হুমায়রা’র। পাগলীতো কারো কন্যা বা ভগ্নি নয়, স্ত্রী হবার প্রসঙ্গ তাই অকল্পনীয় বাতুলতা! মা হতে পেরেছে এ-যে চৌদ্দ-পুরুষের পুণ্যি তার। সেজন্যই আহলাদে দশখানা পাগলী উৎসুক অতিথিদের সাথে তার সন্তানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো নিঃসংকোচে; নষ্ট জন্মের লজ্জা আড়ষ্ট করতে পারেনি অন্তত এই অপ্রকৃতিস্থ কুমারী জননীকে। তাইতো শেষতক মা পরিচয়েই উজ্জ্বল আমাদের কৃশকায় ছায়া।
ছায়ার থিসিস লেখা কী হবে আমি জানি না, তবে ওকে দেখলেই আমার মনে হয় ও নিজেই একটি বিস্তৃত আধেয়। বিশ্লেষণ করার কেউ নেই কোথাও। আমি ওর থেকে বেশি সুবিধাভোগী যে আমার অকাল বিয়ে হয়নি, আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান যে আমার মেয়েকে ছেড়ে দূরে থাকতে হয় না। কিন্তু পাঁজর-জালিয়ে একলা চলা ছায়া আমাদের লক্ষ লক্ষ মা’কে ছাড়িয়ে এক অনিবন্ধিত মা জয়িতা। ছায়াকে বলা হয় না ``You are blessed to be stressed`` কারণ স্কুল প্রত্যাশী সন্তানের আগামী উৎকণ্ঠায় ওকে ইদানীং আরো দিশেহারা মনে হয়। সাত বছরের শিশুটি প্রতিবার বাড়ি গেলে মাকে জিঙ্গেস করে ‘মা আমাকে কবে নিয়ে যাবে তোমার কাছে?’ শুনে আমার চোখ ভিজে গেছে সেদিন। রবী ঠাকুরের ‘কাবুলীওয়ালায়’ মেওয়া বিক্রেতা আর খুকীর বাবা যেমন একই অশ্রুরেখায় থেমেছিলেন, আমরা পৃথিবীর সব মা কী তবে এক?
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এগ্রোনমি এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএস