ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ভারতে আবার ‘ছায়া ফ্যাসিবাদ’ নাকি নতুন শক্তির অভ্যুদয়?

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ১১ মে ২০১৯

গত পাঁচ বছর ধরে ভারতে হিন্দুত্ববাদের স্বর্ণযুগ চলছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ পরিবার চেষ্টা করছে মহারাষ্ট্রের নাগপুরকে ভ্যাটিকান বানিয়ে রাষ্ট্রের উপর ধর্মের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। নাগপুর আরএসএস-এর প্রধান ঘাঁটি। গত পাঁচ বছর গো-মাংস রাখার মিথ্যা অজুহাতে শুধু আখলাককে হত্যা করা হয়নি, হিন্দুত্ববাদ বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরাও নির্মমতার শিকার হয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষ সাংবাদিক ও এক্টিভিস্টদের অনেককে আততায়ীরা হত্যা করেছে। ভয়ের সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের মনে নয় শুধু, এটি সম্প্রসারিত হয়েছে মোদি এবং তার হিন্দুত্ববাদী বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মনেও।

এনডিটিভির জনপ্রিয় নিউজ অ্যানকর রবীশ কুমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির জন্য এই প্রজন্মের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাবেক সভাপতি, বর্তমানে সিপিআই নেতা কানাইয়া কুমারের। স্থান বিহারের বেগুসরাই জেলায় কানাইয়া কুমারের ভাংগাচোরা বাড়ি।

হত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা কানাইয়া কী করে মোদির মতো এক শক্তিমানের বিরুদ্ধে তার ‘আজাদী জেহাদ’ চালিয়ে যাচ্ছেন, তার কি ভয় ডর নেই- এমন প্রসঙ্গ তুলেন রবীশ কুমার। কানাইয়া স্মরণ করেন গৌরী লঙ্কেশকে। সাংবাদিক কাম মানবাধিকার কর্মী গৌরী লঙ্কেশ বিপ্লবী ছাত্রনেতা কানাইয়াকে সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। কিন্তু ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখে তার বাড়ির (রাজারাজেশ্বরী নগর, ব্যাঙ্গালোর) বাইরে অজানা আততীয়দের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। কানাইয়া বলেন, আমারতো সুভাগ্য যে তবুও বেঁচে আছি। উদ্বিগ্ন থাকলেও মা আমাকে দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে।

গত কয়েক বছরে, মোদির শাসনে যেভাবে হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গির খুনিদের খুঁজে পাওয়া যায়নি সে ভাবেই পার পেয়ে যাবে গৌরী লঙ্কেশের খুনিরাও, বলছে ভারতীয় সুশীল সমাজ। এরা কেউ রাজনীতি করতেন না কিন্তু ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনার বিরুদ্ধে ছিলেন। ছিলেন হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন মিলিয়ে এমন একটি ভারত রাষ্ট্র যেটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে এতদিন গর্ব করে আসছিল। সমস্যা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীকে যারা বিরোধিতা করছে তাদেরকে তারা রাষ্ট্রবাদ বিরোধী আখ্যা দিচ্ছে। মোদি-অমিত শাহের বিরোধিতাকারীদের ভারত রাষ্ট্রের বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করছে।

ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিন তাদের চলতি ইস্যুর কাভারে মোদি-বছরগুলোকে আখ্যা দিয়েছে ‘ফ্যাসিবাদের ছায়া’ হিসেবে। তার প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোদি বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র সমাজের উপর কর্তৃত্বমূলক প্রভাব বিস্তার প্রত্যক্ষ করা গেছে। দেখা গেছে, সমাজের একটা অংশকে অন্যের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিতে এবং ধর্মীয় ঘৃণার সংস্কৃতি বিস্তারকে উৎসাহ দিতে। যেটি রাষ্ট্র সরাসরি কর্পোরেট স্বার্থে করেছে।

তাদের মতে, নাগরিক স্বাধীনতার উপর আক্রমণ, ক্ষমতার তীব্র কেন্দ্রীকরণ এবং তার ভয়ঙ্কর বিস্তৃত প্রভাব বিস্তারের জন্য দেশের চরিত্র বদলে দেওয়ার ঘটনাবলি নরেন্দ্র মোদির শাসন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা কালকে মনে করিয়ে দিয়েছে। তবে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে দুই শাসনের মধ্যে। ইন্দিরার জরুরি অবস্থায় জনতার বিচারে দোষীসাব্যস্ত ব্যক্তিকে শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড প্রদান বা খুন করে ‘জাতীয়তাবাদ’ শেখানো হয়নি। সাজা যা দেওয়ার রাষ্ট্র দিয়েছে। ইন্দিরার ইমার্জেন্সিতে সমালোচকরা ‘নন্দিত’ হয়েছে, মোদির সমালোচকদের ‘দেশদ্রোহী’ ‘জনতার শত্রু’ বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা হচ্ছে।

মোদির শাসনে হিন্দুত্ববাদী যে সন্ত্রাসী গ্যাং রয়েছে তারা সরকারের সমালোচকদের তাদের ‘অপকর্মের’ জন্য ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে, ভয়ঙ্কর সমালোচকদের গ্রেফতারের বাড়তি হুমকি দিচ্ছে। সরকারকে সমালোচনামূলক একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য একজন প্রফেসরকে হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্যে কাউকে এত সহজে ভুলানো যাচ্ছে না।

ইন্দিরার ইর্মাজেন্সি থেকে এটির তৃতীয় পার্থক্য হচ্ছে, তখন মিডিয়া সরকারের কব্জায় সেন্সরের শিকার ছিল আর মোদির কালে দু’চারটা বাদ দিয়ে মিডিয়া সম্পূর্ণ হিন্দৃত্ববাদের প্রচারে সেই শিবিরের হয়ে কাজ করছে এবং হিন্দুত্ববাদ বিরোধীদের নৈতিক শক্তিকে নষ্ট করার কুকর্মে সহায়তা করেছে। চতুর্থত, মোদি সরকার কর্পোরেট স্বার্থের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে জড়িত, অথচ ইন্দিরা গান্ধীর শাসনটি কর্পোরেটের সঙ্গে তার পার্থক্য বজায় রেখে, এমনকি কর্পোরেট বিরোধী একটি ‘প্রগতিশীল’ ইমেজ প্রদর্শন করেছে। ফ্রন্টলাইনের মতে, প্রকৃতপক্ষে, ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী কোনও সরকারই মোদি সরকারের মতো কর্পোরেটের সঙ্গে মাখামাখিতে ছিল না। মোদিতো শপথ নিতেই দিল্লিতে এসেছেন আদানীর বিমানে চড়ে।

যাক, এই নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটি কিশোর বয়স থেকে আরএসএস- এর ক্যাডার ছিলেন। আর ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গার সময় নরেন্দ্র মোদি ছিলেন গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, অমিত শাহ ছিলেন তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। প্রায় ২ হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো সে দাঙ্গায়। কংগ্রেস দলীয় লোকসভার সদস্য এহসান জাফরীকে তার গান্ধী নগরের বাসভবনে রায়টকারীরা ঘেরাও করে রেখেছিল।

তিনি দিল্লিতে টেলিফোন করে সোনিয়া গান্ধীকে বিষয়টা অবহিত করলে সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে অনুরোধ করেছিলেন অবরুদ্ধ জাফরীকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু বাজপেয়ী জাফরীকে রক্ষা করেননি। বেলা শেষে দাঙ্গাকারীরা জাফরীর বাসভবনে আগুন দিয়ে জাফরীকে পুড়িয়ে মেরেছিল।

২০১৪ সালে ভারতীয় ধনবাদী গোষ্ঠী মোদিকে যখন ক্ষমতায় আনার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল অনেকে ভেবেছেন মোদি মডারেট হবেন। আরএসএস ক্যাডার হলেও অনেক মুসলিমও তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। ভোটের এজেন্ডায় ধর্ম প্রধান ইস্যু ছিল না। এজেন্ডা ছিল উন্নয়ন, বেকারত্ব, পাচার হওয়া কালো টাকা ফেরত আনা। কিন্তু মোদিবিরোধী গোষ্ঠী মনে করে, ক্ষমতায় এসে মোদি তার নির্বাচনী মেনিফেস্টোর ধারে কাছে না গিয়ে জাত ধর্ম বিভাজন নিয়েই ছিলেন। এখন সে বিভাজনকে পুঁজি করেই আবার ক্ষমতায় আসার লড়াই করছেন।

ভারতের সংসদ নির্বাচনে এরচেয়ে বেশি কখনো প্রতিপক্ষকে নোংরা ভাষার আক্রমণ, প্রধানমন্ত্রীসহ শাসক দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণ বিধি লংঘন, বিরোধীদের নির্বাচনের ফলাফল জালিয়াতির আশংকার ঘটনা ঘটেনি। এত খোলাখুলি হিন্দু-মুসলিম কার্ড নির্বাচনে খেলা হয়নি। বিজেপি শিবির সরাসরি মুসলমান সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটকে নিজেদের দিকে টানতে চাইছে। অন্যদিকে মোদি বিরোধী শক্তি মুসলমানদের সবক দিচ্ছে যাতে তাদের ভোট ভাগ না হয়ে যায়।

বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ যখন নির্বাচনী প্রচারে এসে পশ্চিম বাংলায় বলেন যে নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি করে নির্বাচনের পরে মুসলমানদেরকে বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলবেন তখন বুঝতে পারেন কতটা ভয়ঙ্কর এই বিভাজন। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই হিসাব অনুযায়ীই নরেদ্র মোদির শাসনকালে, মানে ২০১৪ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ শতাংশ। আর ভারতীয় টিভি এনডিটিভির হিসাব অনুসারে শীর্ষ নেতাদের কথা বক্তৃতায় সংখ্যালগুদের প্রতি হিংসার বাণী বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০০ শতাংশ।

১১ এপ্রিল শুরু হওয়া নির্বাচন আগামী ১৯ মে সাত কিস্তিতে শেষ হচ্ছে। ২৩ মে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করা হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ২৮২ সিটে জিতলে নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠন করেছিলেন। আগেই বলেছি, ২০১৪ সালের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে যতসব প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদি দিয়েছিলেন কোনও প্রতিশ্রুতি তার পক্ষে রক্ষা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ একজন অসফল প্রধানমন্ত্রী।

এরপরও অনেক বিশ্লেষক বলছেন শেষ পর্যন্ত মোদিই সরকার গঠন করবেন। পাকিস্তানে ঢুকে তাদেরকে আক্রমণ, হিন্দুত্ববাদের স্বর্ণযুগ প্রতিষ্ঠাই নাকি তাকে জয় এসে দিবে। বিরোধী দলগুলোর অনৈক্যকে পুঁজি করেও সবাই এমন উপসংহার টানছেন।

আমি কিন্তু এখনও মনে করি না যে নরেদ্র মোদি এবারের নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করতে পারবেন। সরকার গঠনে ২৭২ আসন বিজেপির পাওয়া কঠিন হবে। আর দেশের এমন পরিস্থিতিতেও মোদি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে নির্বাচিত হন তবে বলতে হবে ভারতে ‘ছায়া ফ্যাসিবাদ’ নয় সরাসরি হিটলার আর মুসোলিনির মতো ফ্যাসিস্ট সরকারের আবির্ভাব হবে। ভারতের গণতন্ত্রের আদর্শ, বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য, আইনের শাসন সবই সুদূর পরাহত হয়ে যাবে।

আমরা দেখেছি, নরেন্দ্র মোদির পূর্বসূরি নাথুরাম গডসেরা তাদের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আরএসএসের নেতারা প্রকাশ্যে অ্যাডলফ হিটলারের প্রশংসা করতেন। তাদের নেতা সাভারকর ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল গঠনের সময় পূর্ণ সমর্থন করেছিলেন। আগামী ২৩ শে মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে দেখার জন্য- ভারতীয় ভোটাররা কি হিটলার-মুসোলিনি জন্ম দিল না বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য সাধনের শক্তিকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনলো।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন