রাক্ষস, পিশাচ গল্প : এবার কার পালা?
ছেলেবেলায় শুক্লা তিথি, জ্যোৎস্না প্লাবন রাতে, পাড়ার বয়োবৃদ্ধদের কাছে রাক্ষস, খোক্ষস, পিশাচী গল্প শুনতাম। পাড়ার ছেলে-মেয়ে আমরা ভাইবোন, তাড়াতাড়ি রাতের পড়া শেষ করে গল্প শুনে যেতাম। গল্প বলতেও সম্মোহনী ক্ষমতা লাগে। বলার ধরন, শব্দের আকর্ষণ, বডি ল্যাগুয়েজ, পরিবেশ, প্রকৃতির বিরাজিত ভাবনায় কখনো ফুরফুরে বাতাস, কখনো গরমে নাভিশ্বাস। সাথী হারা- ডাহুকের কুহুকণ্ঠ ক্রন্দন। রাত জাগা পাখিরগান, ফুলের ঘ্রাণ, আবছা দূরে শিয়ালের হাক্কাহুয়া ডাকে প্রকৃতি হয়ে পড়ে পারিজাত গদ্যময়। আমরা গল্প শুনতে শুনতে কখনো শিরদাঁড়া হিমশীতল ভয়, কখনো প্রচণ্ড গরমে ও লোম খাড়া ভয়ে ছোট বুকে ধক ধক শব্দ। রাক্ষস, খোক্ষস, পিশাচ গল্প শুনে কখনো ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। আমাদের মতো দুর্বাসনা স্রোতা পেয়ে গল্পবাজ দাদু বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন, দেখাতেন ‘ইয়া বড় রাক্ষস '। 'কান কুলার মতো, দাঁত মুলার মতো, চোখ দিয়ে আগুন বের হয়, এক একটা চুল, জাহাজ বাঁধা রশি। খোক্ষস রাক্ষসের ভাই আর পিশাচ রাক্ষসের মামা।
এতোক্ষণ ছিল রাক্ষস-খোক্ষস-পিশাচ বর্ণনা এবার মূল গল্পের শুরু। এক দেশে এক রাজা ছিল, রাজ্যের সবাই সুখী, এক অনন্যা সুন্দরী রাজকন্যা ছিল। রাক্ষস, খোক্ষস, পিশাচ রাজকন্যার দেশে আসলো। যা হওয়ার তাই হলো!! রাজা রাক্ষস পিশাচ তাড়াতে কোনো ব্যবস্থা নিলেন না। প্রজাদের যুদ্ধের পরামর্শ গ্রহণ করলেন না।
রাক্ষসের সাথে সন্ধি করলো। পাছে যদি যুদ্ধ জয় না হয়? শর্ত- প্রতি রাতে পরিবারের নারী, পুরুষ শিশু রাক্ষস-খোক্ষস-পিশাচের খাবার হবে। রাক্ষস-খোক্ষস-পিশাচ যুদ্ধে প্রজাদের হাজারো অনুরোধে রাজার মন টলেনি। রাজার চিন্তায় প্রজাকূল নয়, নিজে ও পরিবার-পরিজন। সিংহাসন, পরিবার-পরিজন চিন্তায় কোনো প্রজা রাক্ষসের খাবার হতে না চাইলে পাইক পেয়াদা জোর করে বেঁধে নিয়ে যেত।
প্রজা শেষ, সৈন্য সামন্ত শেষ, একদিন পরমানন্দ নিয়ে রাক্ষস-খোক্ষস-পিশাচ পদ করে রাজা, রানীকে খেয়ে ফেললো। বাকি রইলো শুধু এক বংশ প্রদীপ তাদের 'অপরুপা চাঁদবদনী রাজকন্যা’ যার হাসিতে মুক্তদানা ঝড়ে পড়ে, আরো কতো কি... রাক্ষস-খোক্ষস পিশাচ রাজকুমারীকে রাক্ষস দেশে নিয়ে গেলো।
বুদ্ধিমতী রাজকুমারী কান্না করে রাক্ষসের প্রাণ ভোমর কোথায়- 'রাক্ষসের কাছেই জেনে নিলো '। একদিন এক রাজপুত্র রাক্ষসের প্রাণ ভ্রমর মেরে রাক্ষস-খোক্ষস, পিশাচের বন্দিনী রাজকুমারীকে উদ্ধার করে নিজ দেশে নিয়ে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগলো।
এখন আপনারাই বলুন, রাজার কি ভুল ছিল? শেষমেশ আমছালা দুটোই গেলো। তখন কিছুই বুঝতে পারিনি! কি এক ভয়ানক শিক্ষা এ গল্পে ছিল? রাজা চিন্তা করেছিল, 'আমার রাজ্যে লক্ষ্য জনগণ '। শেষ হতে হতে ততোক্ষণে রাক্ষস-খোক্ষস-পিশাচ বুড়ো হয়ে যাবে। রাক্ষসের দাঁত পড়ে যাবে 'মানুষের হাড্ডি চিবোতে পারবে না। একদিন তো মরেই যাবে, খামাখা যুদ্ধ করে লাভ কি? আর আমারই বা কি? সৈন্যসামন্ত আছে, আমি ও রাজপরিবারের সবাই তো নিরাপদে আছি, প্রজারা তো বাঁচে রাজার আদেশ পালনের জন্য'- নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার জন্যই।
রাজা কষ্মিনকালেও বুঝতে পারেননি, 'রাক্ষস-খোক্ষস-পিশাচের ভয়াবহ তাণ্ডব রূপ! যেদিন রাজার তুলতুলে মোলায়েম ঘি মাখানো শরীর রাক্ষস-খোক্ষস দল অট্টহাসিতে ছিঁড়ে খাচ্ছে, তখন রাজা মশাই নিজেকে রাক্ষসের ভোজন ছাড়া অন্য চিন্তার সুযোগ ছিল না। রাজা জানতেনই না, সব রাক্ষস-খোক্ষস, পিশাচ দল তার রাজ্যে ছদ্মরূপে সাবাড় করে চলেছিল। রাজা প্রজাদের কথাগুলো বিশ্বাস করেননি।
এতো বছর পরে আজ ভরা দুধবাটি জ্যোৎস্না রাতের গল্প এখন আমাদের পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে সত্যি হয়েছে। আজ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে ভর করেছে, মানুষরূপী রাক্ষস-পিশাচ-খোক্ষস নামের 'মাদক ও ধর্ষণ'। এখনো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজের চিন্তায় তেমন প্রভাব পড়েনি বা কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েনি। কসাইখানায় থাকা পশুদের মতো এখনো জাবর কাটছি। প্রায় সবারই ভাবনা- এখন রাজার মতো, 'খামোখা ইয়াবা মাদক, ধর্ষণ নিয়ে কথা বলে- মানুষরূপী রাক্ষস-পিশাচ-খোক্ষস দলের বিরাগী হয়ে লাভটা কি?' আমি তো রাজার মতো' বেশ নিরাপদে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে আছি। মাদক ব্যবসায়ী রাক্ষস, পিশাচ-ধর্ষক- এর বিরুদ্ধে কথা বললে, 'যদি আমার বা পরিবারের ক্ষতি করে? এ চিন্তায় সবাই বিভোর। শুধু বিড়বিড় করে, চুপিসারে কল্পনা করে,বলে' ইস একজন রাজপুত্র যদি আসতো? রাক্ষস-পিশাচ-খোক্ষস মারা যেতো! ঠিক বাংলা সিনেমার মতো। সবাই কম বেশি বাংলা সিনেমা দেখি, কাহিনিকার প্রথমে ভিলেনকে রাক্ষস, পিশাচ বানায়। এরপর ভিলেনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ভিলেনের সাথে সবাই দফারফা করে চলেন। কেউ কিন্তু মুখ খোলেন না। সবাই ভাবেন, 'আমি কেন খামাখা রাক্ষস, পিশাচের বিরুদ্ধে লড়বো?’ 'আমি আমার পরিবার তো এখনো নিরাপদে আছি'। এরই মধ্যে ভিলেনের গাড়ি, বাড়ি, টাকা, লোক, ব্যবসা, মন্ত্রী, মাফিয়া হাতের মুঠোয়।
একদিন নায়কের সুন্দরী বোনকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ব্যস্ ভিলেন রাক্ষস এবার যাবে কোথায়? নায়ক রাজপুত্তুর হয়ে একাই পরিচালকের সাহায্য নিয়ে নিমিষে বোমা, চার-পাঁচ ব্যারেল যুক্ত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে রাক্ষস-খোক্ষস, পিশাচ আস্তানা উড়িয়ে দেয়।(যে আগ্নেয়াস্ত্র এখনো অস্ত্র বাজারে কিংবা কোনো রাষ্ট্রে তৈরি হয়নি) নায়ক বোনকে উদ্ধার করে, আসার সময়ে পুলিশের গাড়ি আসে। পুলিশ অফিসার অস্ত্র উঁচিয়ে বলেন, 'হ্যান্ডস আপ' নায়ককে বলেন, প্লিজ! সানি সাহেব, 'আইন নিজের হাতে উঠিয়ে নেবেন না'। এরই মধ্যে একটা পিস্তল ভিলেনের হাতে এসে যায়, ভিলেন গুলি ছোড়ে। সে গুলিতে নায়ক কিংবা পুলিশ অফিসার আহত হন। পাল্টাপাল্টি গুলিতে ভিলেন খতম। নায়কের গলায় ফুলের মালার ছড়াছড়ি, কখনো আহত নায়কের হাসপাতালে ভর্তি, ডাক্তারের ঠং করে পাত্রে একটি গুলি বের করা, অপারেশন সাকসেসফুল বলা- ছবি শেষ, একটা গান কিংবা ডায়ালগ বেজে সমাপ্ত।
এই হলো বাংলা ছবির চিত্রনাট্য। লেখকও জানেন, বোঝেন ভিলেন খতম না হলে ছবি শেষ হবে না। আবার ভিলেনকে আদালতে পাঠালে নায়কের বারোটা বাজবে, তাই খতম!
এখন প্রশ্ন হলো, নায়ক ছাড়া কি সমাজের রাক্ষস, পিশাচ, খোক্ষস শায়েস্তা করার মতো কোনো সিকোয়েন্স কি চিত্রনাট্যকার, পরিচালক তৈরি করতে পারতেন না?এখনো সে রাজার চিন্তার মতো, 'আমার কিছু হবে না', 'আমার পালা কোনোদিনই আসবে ন‘ কিংবা ‘আমার পরিবারের লোকজন বিদেশে থাকেন।’
পরিচালক, প্রযোজকের ছবি লস হবে, ছবি ফ্লপ করবে? মানে সবার চিন্তা মুনাফা আরো মুনাফা। রাক্ষস-পিশাচ-খোক্ষস দল মানবের ছদ্মবেশ ধরে অট্টহাসিতে বেড়ে চলেছে, পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রে। এখন এমন এক চিলতে জায়গা নেই 'যেখানে মানুষরূপী রাক্ষস-পিশাচ 'তাদের অমানবীয় দুর্নিবীত ইয়াবা মাদক ব্যবসা,ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছেনা?
ধর্ষক পিশাচ এখন বর্ণচোরা রূপে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র এমনকি বাসে/বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে পিশাচ ধর্ষক (বেশ্যা) ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। আমরা লেগে আছি, পরস্পরের কাদা ছোঁড়াছুড়িতে। এটা সরকারের, ওটা পুলিশের, সেটা বিজ্ঞের কাজ। আমাদের কোনো কাজ নেই? অথচ দুর্নিবীত ধর্ষক, মাদক ব্যবসা পুঁজিপতি, আশ্রয়দাতা, মুখোশধারী বর্ণচোরা, বাবার মতো, ভাইয়ের মতো, সমাজসেবক, সাদা মন, দানবীর দুধমন, সরল মন নিয়ে কেউ বসে নেই। পিশাচ, রাক্ষস তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, ভয়ংকর কৌশলে। বসে আছি শুধু আমরাই কখন, কোথায়, কীভাবে, কি-কৌশলে পিশাচ দল ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ, কোমলমতি সন্তান, পরিবার-পরিজনদের। 'বেশি দূর যেতে হবে না'- প্রতিদিনের সংবাদ জানলে রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো।
আমাদের অর্জিত মহান স্বাধীনতা বিশ্বময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে অহর্নিশ জানিয়ে দিচ্ছে, 'আমরা বীরের জাতি'। এ জাতি হারতে জানে না-মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বজ্রনিনাদে শিল্পীর তুলিতে শাণিত হয়েছে, 'এ জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে'। বাঙালি জাতি বুক চিতিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। এতো দিন রাক্ষস-পিশাচের সাথে গল্পের রাজার মতো অনেকেই আপসরফা করে চলেছেন। 'আমার সন্তান, আমরা নিরাপদে আছি'। সেদিন আর বেশি দূরে নেই- এ মাদক রাক্ষস, ধর্ষক (পুরুষ বেশ্যা) দল ভারী করে হামলে পড়বে, এ সমাজ, দেশ, আপনার ও আমার ওপর। কারণ মানুষরূপী এ পশুদের মরে গেছে মনুষ্যত্ব, বিবেক, মনন ও নন্দন। আক্ষরিক অর্থে, মাদক ব্যবসায়ী, ধর্ষক (পুরুষ বেশ্যা) মানুষরূপী হিংস্র রাক্ষস ও পিশাচ। এদের সাথে অন্তত কোনো মানুষের সম্পর্ক হতে পারে না।
আসুন আমরা সবাই মিলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনবান্ধব পুলিশিং ব্যক্তিত্ব, পুলিশ সুপার, গাজীপুর শামসুন্নাহার পিপিএম এর উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে, 'গল্পের অথর্ব রাজা না হয়ে মানবতার শত্রু', মাদক (রাক্ষস) ধর্ষকদের (পিশাচ) পরিবার, সমাজ, দেশ হতে বিতাড়িত করি।
লেখক : কলামিস্ট
পুলিশ পরিদর্শক
বাংলাদেশ পুলিশ
ই-মেইল[email protected].
এসএইচএস/পিআর