চিকিৎসকদের নিজেদের উদ্যোগেই নেতিবাচক ধারণা পাল্টাতে হবে
স্বাস্থ্য সেবার সাথে মানুষজনের আবেগ জড়িত এবং এটি স্বাভাবিক, কারণ প্রশ্নটা জীবন-মৃত্যুর। কিন্তু ভাবনার জগতে শুধু আবেগনির্ভরতা বড় সমস্যা সৃষ্টি করে।
জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি এখন সংসদ সদস্যও। নিজের নির্বাচনী এলাকায় সরকারি স্বাস্থ্য সেবার হাল হকিককত জানতে আকস্মিক পরিদর্শন করে চিকিৎসকদের কর্মস্থলে উপস্থিত না পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একজন ডাক্তারকে ফোন করে কিছু কথা বলেছেন। আর সেই ভিডিও অতি উৎসাহী কেউ মোবাইলে ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করেছে।
মাশরাফির কথায় বাস্তবতা যেমন ছিল, তেমনি তার কথা কিছুটা রূঢ়ও ছিল। আর আবেগের তাড়নায় এক শ্রেণির চিকিৎসক মাশরাফিকে যা বলা যায় তাই বলছে, আবার কিছু মানুষ চিকিৎসকদের এমনভাবে গালি দিচ্ছে যেন স্বাস্থ্যসেবায় সমস্ত দুর্ভোগের জন্য ডাক্তাররাই দায়ী। আর পাঁচটা জিনিসের মতো স্বাস্থ্য সেবা, পরিষেবাও কাউকে উৎপাদন করতে হয়, উৎপাদনে উপকরণ লাগে, তার একটা ব্যবস্থাপনা লাগে। সেই ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকরাই পুরো দায়িত্ব পালন করেন না।
সরকারের আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, স্বাস্থ্যসেবায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের ভূমিকা চিকিৎসকদের কতটা নাস্তানাবুদ অবস্থায় রাখে তা হয়তো আন্দাজও করা সম্ভব হবেনা। তবে একথাও সত্য যে, ডায়গনস্টিক সেন্টার ও ঔষধ কোম্পানি থেকে কমিশন নেয়ার বিনিময়ে এই পেশার নীতি নৈতিকতাকে যে বিসর্জন দিচ্ছেন অনেক চিকিৎসকই, সেটাও অস্বীকার করা যাবেনা।
স্বাস্থ্যসেবা একটি ব্যবস্থাপনা এবং একটি বড় ব্যবস্থাপনা ত্রুটি হল রাজধানীর বাইরের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সরকারি চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি এত বেশি, যে গরিব মানুষের কাছে সরকারি চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছায় সামান্যই। এবং এটি নিয়েই অনেকদিন ধরে বড় বিতর্ক।
গরিব মানুষের বেশি রোগ হবে, বেশি ভুগবে, পয়সার অভাবে ঠিক সময়ে ঠিক চিকিৎসা হবেনা এবং পরিণামে বেশি মরবে— এমন ছবিটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এটি থাকতে পারেনা এদেশে যে দেশের গড় প্রবৃদ্ধি আট শতাংশের বেশি এবং মাথাপিছু আয় ১৯০৮ ডলার। সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য স্বাস্থ্য – যে কোন উন্নয়নকামী রাষ্ট্রের দর্শন। শিক্ষা প্রসারে দেশ পিছিয়ে থাকলে যেমন অগ্রগতি সম্ভব হয় না, ঠিক তেমনি দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত না হলে উন্নয়ন দাবি করা যায় না।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেই শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো দুটো খাতে বড় নজর দিয়েছেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ গত দশ বছরে বেড়েছে বহুগুণ। একটা সময় ছিল যখন নেহাত উপায় না থাকলে মানুষ সরকারি হাসপাতালে যেতনা। কিন্তু দিন বদলের আমলে সরকারি হাসপাতালের চেহারা বদলেছে অনেকখানি, দুর্নাম অনেকাংশে ঘুচছে এবং এগুলোর স্বাস্থ্য সেবার হাল ফিরেছে। সুলভে ভাল চিকিৎসার নির্ভর জায়গা সরকারি হাসপাতাল।
উপরে যা বলা হল তা একটি দিক। একটি মানসম্মত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালাতে হলে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি’র ৮ শতাংশের দাবি শুনে আসছি সেই ছোট বেলা থেকে। কিন্তু তা বাংলাদেশে এ শতাংশের মত। সরকারের এত মনযোগের পরও বাস্তবতা হলে অসুস্থ হলে এদেশের একজন নাগরিককে নিজের থেকে ব্যয় করতে হয় ৬৭ শতাংশ খরচ।
সরকারি হাসপাতালের শতকরা ৩৭ ভাগ চিকিৎসকের পদ খালি। চিকিৎসক সংকট পরিস্থিতিকে প্রতিদিনই নাজুক করে তুলছে। একদিকে চিকিৎসক স্বল্পতা, অন্যদিকে গ্রামে থাকতে চিকিৎসকদের অনীহা সংকটকে তীব্রতর করছে, চিকিৎসা সেবার মান নষ্ট করছে।
বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার জনে ডাক্তারের সংখ্যা ০.২৬ জন, ভারতে বাংলাদেশের চাইতে জনপ্রতি ডাক্তারের সংখ্যা আড়াই গুণ বেশী, শ্রীলঙ্কায় দ্বিগুণ বেশি আর পাকিস্তানে তিন গুণ বেশি।
চিকিৎসকরা গ্রামে থাকে চান না, এটা আমরা শুনি। কিন্তু কেন চান না, তা জানার চেষ্টা করিনা। আমার মনে হয় চিকিৎসক সংগঠনগুলোও পরিষ্কার করে তাদের অবস্থান জানান দিতে পারছে না। চাকরি জীবনের শুরুতেই একজন ম্যাজিস্ট্রেট যেসব সুযোগ সুবিধা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে যান, তার কি সামান্যতমও আছে চিকিসকদের বেলায়? এমন প্রশ্ন চিকিৎসকরা করে আসছেন। সরকার বেশি করে চিকিৎসক নিয়োগ দিক, চিকিৎসকদের যেসব দাবি দাওয়া আছে সেগুলো পূরণ করুক।
কিন্তু, চিকিৎসকদের নিজেদের নীতি নৈতিকতার দিকটি কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকের সাথে ডাক্তারদের যোগসাজশে অপ্রয়োজনীয় লম্বা টেস্টের প্রেসক্রিপশন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে রোগীদের দিক থেকে। মানুষ বিশ্বাস করে এটি আসলে রোগীর সেবার বদলে চিকিৎসকদের নিজেদের পকেটের সেবা। তেমনিভাবে সুবিধা নেয়া হয় ঔষধ কোম্পানিগুলো থেকেও। চিকিৎসকদের নিজেদের উদ্যোগেই এই ধারণা বদলাতে হবে।
সরকারি হাসপাতালে চেনাশোনা না থাকলে ঠাঁই নেই। চূড়ান্ত অবহেলা, বিশৃঙ্খলা। আর বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অতি সাধারণ রোগীও পাড়ি জমাচ্ছেন ভারতে। সামর্থ্য আছে যাদের তারা যাচ্ছেন সিঙ্গাপুরে, ব্যাংককে, মালয়েশিয়ায় বা লন্ডনে।
ভুল চিকিৎসার এন্তার অভিযোগ। সব হয়তো সত্য নয়। কিন্তু আমি নিজে দেখেছি, এদেশের কোন বিখ্যাত চিকিৎসক কাউকে বলেছেন তার আর বাঁচার সম্ভাবনা নাই। সেই রোগী বিদেশে গিয়ে শুনলেন তার আসলে কিছুই হয়নি। এমন দৃষ্টান্ত লিখে শেষ করা যাবেনা। চিকিৎসক সমাজ এ নিয়ে ভাববেন আশা করি। তারা ভাববেন চিকিৎসার প্রতি আস্থা ও সাহস কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায়। নিয়মমাফিক কাজকর্মের বাইরে গিয়েও নতুন ভাবনাচিন্তা এবং কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
আমার বিশ্বাস দৃঢ় - স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নানা সংকট সত্ত্বেও অনেক উন্নতি করার সাধ্য আমাদের আছে। হাসপাতাল চত্বর পরিষ্কার করা একটা বড় দরকারি কাজ। এটি অসাধ্য কোন কাজ নয়। একটা নিয়ম করে ফেলতেই হবে যে, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কমপক্ষে দু’জন ডাক্তারকে সারা দিন হাসপাতালে থাকতে হবে, প্রতিবার কল দিয়ে রোগীকে দেখার জন্য ডেকে আনার প্রথা বন্ধ করতে হবে। এটুকুই পরিস্থিতির অনেক বদল ঘটাবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/জেআইএম