ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মানব সভ্যতার বোবা কান্না আমরা কি শুনতে পাচ্ছি?

অঘোর মন্ডল | প্রকাশিত: ০১:০০ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

মানব সভ্যতা কী বিশ্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে! তা না হলে তার রোগাক্রান্ত ক্ষয়িষ্ণু চেহারাটা বার বার বেরিয়ে পড়ছে কেন? বিশ্বব্যাপী অসহিষ্ণুতার ধ্বজাধারীদের দাপট এভাবে দিনে দিনে বাড়বে কেন?

মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আজ পৃথিবীর কোথাও নেই। পশ্চিম থেকে পূর্ব যে দিকে চোখ রাখবেন চারিদিকে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল! এর সব শেষ নজির আরব সাগরের পাড়ে দ্বীপ দেশ শ্রীলংকা। বহু হিংসা আর রক্তবন্যা পেরিয়ে একটা স্থির অবস্থায় এসেছিল শ্রীলংকা। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব জাতিগত বিদ্বেষ অনেক কিছু সামাল দিয়ে দেশটার মানুষ কিছুটা স্বস্তির হাওয়া খুঁজে পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎ সেখানে আবার সন্ত্রাসের দমকা হাওয়া। যা কেড়ে নিল দেশী-বিদেশী বহু মানুষের প্রাণ!

ইস্টারসানডতে গীর্জায় সন্ত্রাসী হামলা। সে হামলা থেকে বাদ যায়নি কলম্বোর পাঁচ তারকার হোটেলও। এই হামলাকে সন্ত্রাসী হামলা বা জঙ্গী হামলা যে শব্দেই ব্যাখ্যা করা হোক, আসলে এটা হচ্ছে সভ্যতার বুকে অসহিষ্ণুতার ছুরি চালিয়ে তাকে রক্তাক্ত করা। ধর্মের নামে কট্টর দক্ষিণপন্থী অসহিষ্ণুতার ধ্বজাধারীদের দাপট দিনে দিনে বাড়ছে। দেশে দেশে সমাজের বিরাট অংশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। উগ্রতা ভর করছে মানুষের মনোজগতে। আর সেই উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে। সেটা কখনো যুক্তরাষ্ট্রে, কখনো ব্রিটেনে, কখনো মধ্যপ্রাচ্যে কখনো বা নিউজিল্যান্ডের মত দেশে।

সেটা ধর্মের নামে। বর্ণের নামে। আসলে সন্ত্রাসের কোন সীমা রেখা নেই। সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম নেই। দেশ নেই। সন্ত্রাস সন্ত্রাসই। সন্ত্রাসীকে সন্ত্রাসী হিসেবেই দেখতে হবে। সেটা তারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই ঘটাক না কেন। এদের মূল লক্ষ্য মানব সভ্যতাকে বিপন্ন করা। শান্তির পৃথিবীকে অশান্তির রক্তস্নান করানো। এবং সেই রক্ত কোন বিশেষ ধর্মের মানুষের নয়। কোন বিশেষ বর্ণের মানুষেরাও নয়। আজকের পৃথিবীতে এটাই নির্মম এবং নিষ্ঠুর সত্য। সেটা স্বীকার করতে দ্বিধা করলে আরও বড় বিপর্যয়ের দিকে চলে যাবে পৃথিবী।

শ্রীলংকায় যারা হামলা করলো তাদের পরিচয় ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। একই সাথে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে কারা হামলা করেছিল তাও জানা গেছে। অনেকে শ্রীলংকায় হামলাকে নিউজিল্যান্ড হামলার প্রতিশোধ হিসেবে দেখার চেষ্টা করছেন। খুব ক্ষুদ্র চিন্তা থেকে সহজভাবে এই সমীকরণ মেলাতে গেলে আসল কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুঁজতে হবে কোন মনস্তত্ত্ব থেকে এই হামলা।

যে হামলা আধুনিক, সভ্য পৃথিবীকে ধ্বংস করছে সেটা কী শুধুই ধর্মের কারণে! মানা কঠিন। অসহিষ্ণুতা , অসৌজন্যতা আজ বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা কেড়ে নিচ্ছে নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ পর্যন্ত।

কলম্বোর হামলায় রক্তক্ষরণ হলো বাংলাদেশের হৃদয় জুড়েও। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী শেখ সেলিমের আট বছরের নাতি বাবা-মার সাথে ছুটি কাটাতে গিয়েছিল দ্বীপ রাষ্ট্রে। দেশটার নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করেছেন। কিন্তু সে কেন, কেউ কী ভাবতে পেরেছিল তাকে ফিরতে হবে কফিনবন্দী হয়ে!

সন্ত্রাসী হামলায় বাবার সামনে মুহূর্তের মধ্যে নিষ্পাপ শিশুটির দেহ পরিণত হলো রক্তপিণ্ডে! এই অসম্ভব ভারী দেহের বোঝা কাঁধে নিতে হলো তার আত্মীয় স্বজনকে। আত্মীয়– স্বজনের চোখের জল দেখলো গোটা পৃথিবী। তাদের আর্তনাদ আর আহজারি শুনলাম আমরা ব্যথিত হৃদয়ে। কিন্তু মানব সভ্যতার বোবা কান্না আমরা শুনতে পাচ্ছি না।

সভ্য পৃথিবীর রুগ্ন চেহারা আজ আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে। যে কারণে পৃথিবী শুদ্ধ বিবেকবান মানুষ একবাক্য স্বীকার করছেন; সন্ত্রাস আজ কোন একটা দেশের সমস্যা নয়। কোন একটা জাতি বা ধর্মাবলম্বী মানুষের সমস্যা নয়। এটা এক বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবী আর সভ্যতার সামনে বড় এক সংকট। যে সংকটের কথা ভাবলে উদ্বিগ্ন হতে হয়। বিশ্ব নেত্রীবৃন্দও সেই উদ্বেগের কথা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন।

আসলে এখন আমরা কেউ নিরাপদ নই। যে কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিনে বার বার বলছেন, সন্ত্রাস মোকাবিলার সক্ষমতা হয়তো আমাদের আছে। কিন্তু সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত আমরা নই। আসলে ঝুঁকিমুক্ত আজ পৃথিবীর কোন দেশই নয়। নিউজিল্যান্ডের মত শান্তিপ্রিয় এক দেশে যদি অশান্তির আগুন জ্বলতে পারে, কেড়ে নিতে পারে অসংখ্য প্রাণ, তাহলে আপনি ঝুঁকিমুক্ত ভাববেন কীভাবে নিজেদের!

আসলে আজ গোটা পৃথিবী জুড়ে একটা কথা কোটি কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে; অসহিষ্ণুতা, উগ্রতাকে রুখতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে বিবেকবান মানুষগুলোকে। সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিরাট ভরসা হিসেবে এখনো পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন। সময় এসেছে তাদের এগিয়ে আসার। তা নাহলে মানব সভ্যতা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাবে।

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন