শমী, সাংবাদিকদের ‘চোর’ বলে ছোট করেছেন নিজেকেই
খুব কম বয়সে পড়া পঙ্ক্তিমালার অনেকগুলোর ঘোর থেকে এখনও বেরুতে পারিনি। আসলে বেরুতে চাইনি বলেই বেরিয়ে আসা হয়নি। ‘আপনাকে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সে হয়’- নৈতিকতা, নৈতিক শিক্ষার বোধ, বোধহয় এভাবেই তৈরি হয় আমাদের মধ্যে; যদি তা ধারণ করি মনে প্রাণে।
লাইনকটা ক’দিন হলো বারবার মনে পড়ছে। ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে ‘অভিনেত্রী’, উদ্যোক্তা শমী কায়সারের অশোভন আচরণ আমাকে কেমন যেন অস্থির করে তুলেছে। শমী কায়সারকে শিল্পী না বলে ‘অভিনেত্রী’ বলতে আমার সাচ্ছন্দ্য হচ্ছে বেশি।
‘শিল্পী’ আর ‘অভিনেত্রী’র মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অভিনেত্রী কেবল ‘অভিনয়’ করেন বিভিন্ন চরিত্রে। দুষ্টু চরিত্রে, মন্দ চরিত্রে আবার ভালোমানুষ, মানবিক মানুষ, বড় মানুষ, মহৎ-মহান মানুষের চরিত্রেও। শিল্পী হয়ে ওঠা অনেক বড় ব্যাপার, অনেক সাধনার। অনেক উদারতা, মানবিকতা আর নৈতিকতার উৎকর্ষ পেরিয়ে সে পর্যায়ে পৌঁছুতে হয়। শিল্পী হয়ে ওঠে মানুষ। সবাই শিল্পী নয়।
প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠানে মোবাইল ফোন খুঁজে না পাওয়ায় শমী কায়সারের যে তুলকালাম, সাংবাদিকদের অসম্মান তা আমায় বিস্মিত করেছে রীতিমতো। প্রকাশ্যে হলঘর ভরা সংবাদকর্মীদের এভাবে অপমান করার, ‘চোর’ বলার সাহস কি করে পান তিনি? ছবিতে দেখলাম, শমীর সঙ্গে ছিলেন আরেক বর্ষিয়ান নারী সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি। তিনিও কোনো প্রতিবাদ করলেন না! মাত্র ক’দিন আগেই না ব্যারিস্টার মঈনুল মাসুদা ভাট্টির চরিত্রহননে পুরো সাংবাদিক সমাজ, তার হয়ে, তার পক্ষে এক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
শমী যেভাবে সাংবাদিকদের হেনস্থা করেছেন তার বর্ণনা আমি লিখতে চাই না। আমার কাছে তা অসম্মানের, বড় অশ্লীল, রীতিমতো অকথ্য নির্যাতন যাকে বলে। এমন অসভ্য আচরণ কেউ আশা করেনি তার কাছে।
কেউ কেউ বলছেন শমীতো এমনই, ঔদ্ধত্য, দাম্ভিক, বাইরে মানবিক। আসলে বিষয়টা হলো, যখন কারো বাবা চিকিৎসক হন, লোকে মনেই করে তার চিকিৎসকদের প্রতি স্বাভাবিক একটা সম্মানবোধ থাকবে। কারো বাবা যখন আইনজীবী, লোকের মনে করাটা স্বাভাবিক যে, তার আইনজীবীদের প্রতি একটা সম্মানবোধ থাকবে। শমীর সম্ভবত বাবার প্রতিও সম্মানবোধ নেই। যদি থাকতো তবে কি করে এমন আচরণ তিনি করতে পারেন? এই প্রেস ক্লাবেই তো তার বাবার নাম খোদাই করা আছে।
শহীদুল্লাহ কায়সার দেশবরেণ্য সাংবাদিক ছিলেন। ছিলেন লেখক, কথাসাহিত্যিক। বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবীদও। যিনি ’৭১ এ নিখোঁজ ও নিহত হয়েছেন। সেই শমীরই যখন সাংবাদিকদের প্রতি অশোভন আচরণ প্রকাশ পায় তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, সাংবাদিকতা পেশাটির প্রতিও তার সম্মান নেই।
অথচ একজন অভিনেত্রী শমী কায়সার হয়ে ওঠা, সেখান থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে আজকে এফবিসিসিআ ‘র পরিচালক হওয়া পুরো যাত্রাপথ জুড়েই সাংবাদিক আর মিডিয়ার অনেক অবদান রয়েছে শমীর এই এগিয়ে যাওয়ায়।
কেউ কেউ দেখলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শমীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও বিষোদগার, অযাচিত মন্তব্য করছেন। আমি মনে করি তার ব্যক্তিগত জীবন তার। সেটি তার একান্ত, ব্যক্তিগত, নিজস্ব। সেখানে আমাদের অনুপ্রবেশ না করাই ভালো। অধিকারও নেই। শমী যে অসভ্য আচরণ করেছেন, অশ্লীল আক্রমণ করেছেন সাংবাদিকদের, আমরাও যদি সেই একই আচরণ করি- তাহলে আর কোন পার্থক্য থাকে না, সভ্য-অসভ্যতে। সভ্যতায়-অসভ্যতায়।
শমী কায়সার রাজনীতি করতে চান। সাংসদ হতে চান। গত নির্বাচনের আগে পর্যাপ্ত ছোটাছুটিও করেছেন ক্ষমতাবানদের কাছে। তিনি তা চাইতেই পারেন। সে অধিকার তার শতভাগ রয়েছে। কিন্তু মানুষকে অসম্মান করে, ছোট করে, তুচ্ছ করে, তাচ্ছিল্য করে কেউ কি কোনো দিন রাজনীতি করতে পেরেছেন? তবে সে রাজনীতি তো বড় বিছিন্ন রাজনীতি। মানুষহীন, মনুষত্ব্যহীন রাজনীতি।
আওয়াজ উঠেছে, দাবি উঠেছে, শমী যেন প্রকাশ্যে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চান। যৌক্তিকতা আছে এই চাওয়ায়। কিন্তু সাংবাদিকদের যে শমী ‘চোর ভাবেন’ এই মানসিকতা বদলাবেন কীভাবে?
ক্ষমতা বলয়ে থাকলে বড় পদ পাওয়া যায়, ব্যবসা করলে টাকার মালিক হওয়া যায়। কিন্তু চিন্তা বিশ্বাসের পরিবর্তন না ঘটলে মানসিকতার পরিবর্তন হয় না। আর চিন্তা বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটে জীবনযাপনের প্রভাবে। চিন্তার পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায়- কথায় নয়, কাজে।
নিজের কথা দিয়ে শেষ করবো, যদি চাই লোকে আমায় সম্মান করুক, লোককে তবে সম্মান করতে হবে আগে, মন থেকে, লোক দেখানো নয়। আমাকে মনে রাখতে হবে, মানুষকে অবহেলা করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, কেউ কখনও বড় হতে পারেনি। যদি সত্যিই মানুষকে সম্মান করি বলে দাবি করি, ধারণা দিতে চাই,তবে আমাকেও মানুষের মন জয় করতে হবে, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর অন্তরের সততা দিয়েই।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/এমএস