ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মতিন বৃত্তান্ত ও কিছু প্রশ্ন...

নাসরীন গীতি | প্রকাশিত: ১০:২৪ এএম, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

নামে নামে যমে টানের মতোই- শুধু বিদ্যুৎ মিটারে নাম থাকায় বকেয়া বিলের দায় নিতে হয়েছে কুমিল্লা মুরাদনগরের দিনমজুর আব্দুল মতিনকে। এতো স্বচ্ছ আমাদের পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা যে, বিদ্যুৎ সংযোগ না পেয়েও ১৭ মাসের বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের দায়ে জেলে নেওয়া হলো মতিনকে। দুইদিন কারাবাসের পর গত বৃহস্পতিবার (১৯ এপ্রিল) মুক্ত হয়েছেন তিনি।

দরিদ্র এই মানুষটির অপরাধ ছিল মিটারটি তার নামে, বকেয়া বিল পরিশোধে তাকেই চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে কেন তা আমলে নিলেন না। সাদাসিধে এই মতিনের মাথায়ই আসছিলো না, চিঠিটি কেন তাকে দেয়া হলো। তার তো একটাই কথা- তার ছোট্ট ঘরে তো কুপি বাতি জ্বলে, বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হওয়ার তো সুযোগই হয়নি তার। তাহলে কেন এতো ঝক্কি পোহাতে হলো তাকে! লঘু পাপে গুরু দণ্ড পেতে হয়েছে! এরকম প্রশ্ন তো মতিন করতেই পারেন।

সাধারণের প্রশ্ন হলো- যাদের জন্য তার কারাবাস, এতো হয়রানি, তাদের কি শাস্তি? গণমাধ্যমে আব্দুল মতিনকে নিয়ে সংবাদ প্রচার হলে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। খানিক নড়ে-চড়ে বসে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে কর্তৃপক্ষ। দু'দিনের মাথায় তারাও ঘটনার সত্যতা পায়।

এই ঘটনায় সম্পৃক্ততার দায়ে ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এছাড়া ভুক্তভোগী মতিনের কাছে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমাপ্রার্থনাও করেছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে দরিদ্র আব্দুল মতিনকে মুক্ত করতে পাশে দাঁড়ান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্টের জেলা প্রকল্প কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছানা উল্লাহ।

মতিনের ভাগ্য ভালোই বলা চলে, সহজে আইনি সহায়তা পেছেন তিনি। নইলে এ রকম তালগোল পাকানো মামলায় তাকে মুক্ত করতে পরিবারের যে কত জোড়া জুতা ক্ষয় হতো তা আন্দাজ করা কঠিন। যাক, মতিনের জেল পর্যন্ত যাওয়ার সেই মহাকর্মটি যারা করেছেন, সেই মুরাদনগর থানা পুলিশের মনে বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের প্রশ্ন একবারও খোঁচা দেয়নি বলেই মনে হচ্ছে।

সম্প্রতি আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই ঘটনায় কি প্রশাসনিক অবহেলা বা অদক্ষতার প্রমাণ মিলেছে, নাকি বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানকারী সংশ্লিষ্টদের লোভাতুর মনের ক্ষুধা ফুটে উঠেছে! এই আব্দুল মতিন, যিনি চার বছর আগে কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করে অনুমোদন পান। সেসময় স্থানীয় আবুল কালাম আজাদ ও আবুল বাসারের নেতৃত্বে একটি দালাল চক্র প্রত্যেক গ্রাহকের কাছ থেকে মিটার প্রতি ১০/১৫ হাজার টাকা আদায় করে।

তখন মতিন তাদেরকে চার হাজার টাকাও দেয়। কিন্তু চাহিদামাফিক টাকা না পেয়ে মতিনের নামে ইস্যুকৃত মিটারটি স্থানীয় সফিকুল ইসলামকে দিয়ে দেয় দালাল চক্র। কাগজে নাম আব্দুল মতিনের, কিন্তু ছবি সফিকুলের, বিদ্যুৎ সংযোগ চলে যায় মতিনের বাড়ি থেকে সোয়া কিলোমিটার দূরে সফিকুলের বাড়িতে। অথচ এ বিষয়টি জানাই ছিল না কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের!!

বিষয়টি একটু গোলমেলে ঠেকছে না! একটা প্রাতিষ্ঠানিক ফরম-এ দাপ্তরিক কাজের জন্য একজনের নাম আর অন্যজনের ছবি আছে। একজনের নামে একটি মিটার বরাদ্দ, অন্যজন তা দিনের পর দিন ব্যবহার করছে। একটি, দু'টি নয় সতেরটা মাস একজন গ্রাহক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করছে না, এটা কিভাবে দৃষ্টি এড়িয়ে গেল পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের? যদিও এর চেয়ে অনেক জটিল কাজের সহজ সমাধান তারা করতে পারেন।

অবশ্য পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ এতগুলো মাসের মধ্যে একবার মিটারপ্রাপ্ত আব্দুল মতিনকে বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য চিঠি দিয়ে দায়িত্ব সেরেছিলেন। আর তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য হিসেবে নেয়নি কেন মতিন, এটাই ছিল তার অপরাধ। কিন্তু ঘটনার মারপ্যাঁচে পড়ে দরিদ্র এই মতিন যে গত ক'দিন ভুগলেন তার কি হবে? পল্লী বিদ্যুৎ বলছে, এটা ভুল বোঝাবুঝির ফল, তারা মামলাটি নিষ্পত্তি করেছে। এতো কথা বলার একটাই লক্ষ্য- এবার তো একটু নড়েচড়ে বসুন পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি। দেখুন এরকম ঘটনা কিংবা আড়ালে থাকা একটু ভিন্ন কিছু দৃশ্যমান হয় কি না।

বিদ্যুৎ পল্লী হোক আর পৌর-ই হোক- সম্পদ তো দেশেরই। তাই অপব্যবহার না করে, অযথা উদর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে না চাপিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরাই আরেকটু দায়িত্বশীল আচরণ করুণ না। দেখুন কতটা শান্তি আর স্বস্তি পাবেন নিজেরাও, সেই সাথে দেশও।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন