নারীর প্রতি সহিংসতা ও আইনের শাসন
একের পর এক নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রতিদিনের সংবাদপত্র খুললেই একাধিক নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার বিবরণ দেখতে পাই আমরা। এসব দেখে আজকাল কেমন অসুস্থ বোধ করি। বিশেষ করে ইদানিং মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক নারী ও পুরুষ শিশুদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের বিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।
আসলে হচ্ছেটা কি দেশে? কেন হচ্ছে এসব? কোথায় সমস্যা? আমাদের মনুষ্যত্ব কি দিনে দিনে পশুত্বের দিকে যাচ্ছে? এমন হাজারো প্রশ্নের ভিড় আসে মনের মাঝে। কন্যাসন্তানের পিতামাতারা যেন এক মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মাঝে নিজেদেরকে খুঁজতে শুরু করেছেন। কন্যা হয়ে জন্ম নেয়া কি এই সমাজে এখনও পাপ বলে মনে করা হয়? নারীদেরকে কি এখনও গণিমতের মাল মনে করা হয়? নারীদেরকে কি যে যেভাবে যেমন খুশি তেমন করে নির্যাতন করে পার পেয়ে যেতে পারে?
ভাবতে ভাবতে আসলেই গা ঘেমে আসে আজকাল। এ কেমন করে সম্ভব? ২০১৯ সালে এসেও যদি মনের ভিতর এমন ভাবনা আসে তাহলে কোথায় আমাদের উন্নয়ন আর কোথায় আমাদের নারীর ক্ষমতায়ন? অথচ আমাদের সরকার নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় গোটা বিশ্বের কাছে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের একটি অন্যতম ছিলো নারীর ক্ষমতায়ন এবং সেখানে আমাদের সরকারের অর্জন শতভাগ সফল।
এস ডি জি নিয়ে কাজ চলছে। আশা করা যায় এখানেও সফলতা আসবে কিন্তু তারপরও প্রশ্ন আসে এত অর্জনের কোন অর্থ কি থাকে যদি নারীর সঠিক মর্যাদাই প্রতিষ্ঠা না করা যায়। নারীরা একদিকে এগিয়ে যাচ্ছে আবার অন্যদিকে চলছে নারীর প্রতি নির্যাতনের উৎসব অথচ একটি ঘটনারও বিচার হয়নি ঠিকভাবে।
“নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়” নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় আছে অথচ আমরা এই মন্ত্রণালয়ের তেমন কোন শক্ত ভূমিকা দেখছি না। একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ে যেন কোন হাওয়াই লাগছে না। অথচ দেশের কোথাও কোন নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে এই মন্ত্রণালয়ের কঠোর ভূমিকা থাকার কথা সবার আগে।
দেশে প্রচলিত আইন থাকলেও নাই সেসবের প্রয়োগ। সম্প্রতি ফেনির সোনাগাজির নুসরাতের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাই আমাদেরকে যেন আরও একবার চোখের পর্দাকে সরিয়ে দিয়ে গেলো। আমাদের আইন রক্ষা বাহিনীর ভূমিকা কতটা বিতর্কিত বাদ যায়নি সেই জায়গাটিও। অথচ এই অভিযোগ এবারই প্রথম আসেনি। এর আগেও প্রতিটি ঘটনায় আমরা শুনেছি যে পুলিশ সঠিক সময়ে মামলা নিতে চায় না।
প্রশ্ন করাই যায়, কেন? কেন আমাদের থানার কর্মকর্তারা মামলা নিবে না? তাদের কাজইতো হচ্ছে দেশের প্রতিটা নাগরিকের সুরক্ষাকে নিশ্চিত করা। আমরা বলছি না আমাদের সমাজ রাতারাতি পুত-পবিত্র হয়ে যাবে আর সকল নাগরিক সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবে কিন্তু শুরুটাওতো হতে হবে। সেই শুরুটাই যেন আর হচ্ছে না।
মাদ্রাসায় শিক্ষকদের কর্তৃক শিশু বলাৎকারের ঘটনার মত ঘটনাও আসছে আমাদের সামনে। অথচ কেউ যেন পাত্তাই দিচ্ছেনা এইসব। ছোট ছোট কোমলমতি বাচ্চাদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে এমন ভিডিও দেখতে হচ্ছে। প্রমাণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও বিচার নিশ্চিত করতে কোথায় আটকাচ্ছে সেটাও আমাদের কাছে পরিষ্কার না।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিদিনের বক্তৃতায় সমাজে ন্যায় ও সাম্যের চর্চা বাড়ানোর আহ্বান জানান অথচ ঘটে চলেছে এর বিপরীতটাই। ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। প্রতিবেশীর যেকোন ভালোমন্দই আমাদেরকে ছুঁয়ে যায়। ভারতের নির্বাচনে কার কি অবস্থা সে নিয়ে আমাদের মাঝে আলোচনা চলে প্রতিনিয়ত। সেই ভারতে যখন নির্ভানা ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা দেশ তোলপাড় হয়ে উঠেছিলো যার ফলশ্রুতিতে দেশটি তার আইন পরিবরতন করতে বাধ্য হয়েছিলো। সেখান থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারিনা।
জাহাঙ্গীরনগরের একটি নারী নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্ট একটি রুল জারি করেছিলো যেখানে বলা হয়েছিলো সকল প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রোধে আইন বা নীতিমালা তৈরি করতে হবে। কোথায় গেলো সেই আদেশের বাস্তবায়ন? না সরকারের দিক থেকে ফলো-আপ আছে না আমাদের সামাজিক সংগঠনগুলোর থেকে আছে কোন আলোচনা বা আন্দোলন।
বিচারহীনতা আজকে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে কোন নারী যখন তার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিবাদ করতে যায় তখন কেবল হেনস্তা হচ্ছে সেটাই নয় জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার মত ঘটনা ঘটানোর সাহস পাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। এত সাহস তারা পেলো কোথায়? এর উত্তর আশা করি নতুন করে দেয়ার কিছু নাই। বছরের পর বছর ধরে যে অবস্থা চলে আসছে সেই অপরিবর্তিত মানসিকতাই সাহস দিচ্ছে।
তারপরও আমরা আশাবাদী জাতি। আশা ছাড়া আমাদের কি বা করার আছে। আর আমাদের সে আশার একমাত্র জায়গাটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি চাইলেই কেবল এদেশে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব। আজকের বাস্তবতা তাই বলছে। নুসরাতের ঘটনায় যদি তিনি ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত না হতেন তাহলে হয়তো আর দশটা ঘটনার মত জীবন্ত পুড়িয়ে মারার মত এমন আদিম ও বন্য প্রবৃত্তির অপরাধটিও পার পেয়েই যেত। আর সে সাহসেই জেলে বসেও সিরাজের মত অপরাধীরা নুসরাতদেরকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়ে যেতে পারে।
এই ঘটনাটির সাথে কোথায় যেন ২০১২ সালের দিল্লীতে ঘটে যাওয়া নির্ভয়ার ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নির্ভয়া ছিলো মেয়েটির ছদ্ম নাম। আসল নাম পরিচয় অনেকদিন পর্যন্ত কেউ জানেনি। আর আমাদের দেশে প্রথম মুহূর্ত থেকেই আগে ভিক্টিমের নাম পরিচয় সামনে আসে তারপর হয়তো অপরাধীর পরিচয় জানা যায়। নির্ভয়াকে গণধর্ষণ করেছিলো ছয়জন এবং মেয়েটিকে পরে আর বাঁচানো যায়নি। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসার জন্য পাঠানোর পরেও বাঁচেনি মেয়েটি কিন্তু ভারতের জনতা সে ঘটনাকে ছেড়ে দেয়নি। রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছিলো শক্ত ও সঠিক পদক্ষেপটি নিতে।
আশা করছি আমাদের নুসরাতের ঘটনাটির মাধ্যমেই যেন নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় রাষ্ট্রের অচলাবস্থার অবসান হয়। প্রতিবাদ কম হচ্ছে না কিন্তু দরকার আমাদের সরকার ও প্রশাসনের সঠিক ও আন্তরিক পদক্ষেপ। সমাজের যেখানেই এমন অপরাধ ঘটুকনা কেন একটি ঘটনাও যেন বিচারের বাইরে না যায় এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেবল সরকারের। আমরা আশা করছি সরকার নুসরাতের ঘটনাকে তেমনভাবেই নিয়েছেন এবং একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে দেশ থেকে আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম