এমন কেন মাদ্রাসা শিক্ষকরা?
শান্তনু চৌধুরী
আমাদের ছেলেবেলাটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই শিক্ষকদের বেদম মার খেয়ে কাটিয়ে দেয়ার ছেলেবেলা। পড়া না পারলে মার, দুষ্টুমি করলে মার, পোশাক-আশাকের জন্য মার। অনেক সময় এমনও হয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই একটা অজুহাত বের করে শিক্ষকরা গণহারে মারছেন। এমন শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে আতঙ্কের ছিলেন ‘হুজুর’ স্যার। তিনি শিক্ষার্থীদের এমন বেদম মার দিতেন যে অনেক শিক্ষার্থীই কোনো অপরাধ করলে আর ক্লাসে আসতে চাইতো না।
বিশেষ করে ‘হুজুর’ যদি জানতেন সেই ছাত্র দুপুরের নামাজ পড়েনি। এদের অনেকে আবার স্কুলের ক্লাসের বাইরে মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতো পার্টটাইম হিসেবে। মাঝে মাঝে খুব ভোরে বা সাত-সকালে মাদ্রাসার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতাম শিক্ষক শপাং শপাং করে বেত দিয়ে মারছেন। শুধু বেত নয়, মারার নানা বস্তু এবং একইসঙ্গে নানা কায়দা থাকতো। সে মারের চোটে ছাত্রতো পারলে পালিয়ে বাঁচে।
পরে অনেককে ক্লাসে দেখতাম লাল দাগ বা মারের কারণে ঘা হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে ক্লাসে আসতে। এরপরও বাবা-মায়েদের এক অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল ‘হুজুর’দের প্রতি। তারা ভাবতেন মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার শিক্ষক বা যারা ধর্মের তত্ত্বকথা আওড়ান, একইসঙ্গে যেহেতু ‘হুজুর’ বলে তাদের ডাকা হয় তারা আক্ষরিক অর্থেই মোগল বাদশাদের মতো হুজুরের আসনে থাকেন। তারা মাদ্রাসা বা বাড়িতে কোরআন পড়ান বা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেন।
এলাকার মানুষ মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে মেয়েরা আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। একটা সময়ে হয়তো এসব কুকর্মের কথা বাইরে প্রচার হতো না। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে।
ফেনীর নুসরাতের মতো সাহসী মেয়েরা বেরিয়ে আসছে। যারা জানে অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিতে, যারা জানে রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। হয়তো নুসরাতকে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু জীবন দিয়ে তিনি বুঝিয়ে গেছেন এবার তবে হোক প্রতিবাদ। এই যে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সারাদেশে আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটছে মাদ্রাসা শিক্ষকের দ্বারা। কুমিল্লার দেবিদ্বারে এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর মসজিদের ইমামকে আটক করে পুলিশে দেয় এলাকাবাসী।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় এক মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় মাদ্রাসা শিক্ষককে। ডেমরায় এক শিশুকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ উঠেছে মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে। শ্যামপুরে মাদ্রাসা ছাত্রের আত্মহত্যার পর তার পরিবারের অভিযোগ, শিক্ষকের নিপীড়ন নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে সে। একই রকম ঘটনা ঘটেছে খিলগাঁও রেললাইনে আত্মহত্যা করা মাদ্রাসা ছাত্রের বেলায়ও।
উদাহরণ দিতে গেলে এমন অনেক তথ্যই আসবে। আরো কতো কতো ছেলে-মেয়ে নীরবে নির্যাতন সহ্য করে মাদ্রাসায় পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে তা অজানাই হয়তো। কেনো এমনটি হয়। একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে শুরু করি, একবার সানি লিওন বাংলাদেশে আসার কথা শুনে প্রতিবাদে ফেটে পড়লো এমন হুজুররা। তারা কোনো মতেই সানি লিওনকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেবেন না। দুষ্টুরা ফেসবুকে ট্রল করতে লাগলেন, ‘হুজুররা সানি লিওনকে চিনলেন ক্যামনে?’।
আমাদের দেশে ছেলে মেয়েদের মেলামেশাকে সহজ চোখে দেখা হয় না। দেখা হয় না তাদের বন্ধুত্বকেও। এটা অবশ্য সব ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু ধর্মান্ধ, কূপমণ্ডুক যারা তাদের ক্ষেত্রেতো বটেই। আর মাদ্রাসায় যারা পড়ান বা পড়ালেখা করেন তাদের ক্ষেত্রে নারী বর্জিত থাকাটা আরো বেশি। সে কারণে তারা হঠাৎ করে নিষিদ্ধ গন্ধম ফল পেলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এক সময় মেয়েদের মাদ্রাসায় যাওয়ার সংখ্যা কম ছিল। হুজুরদের বাসায় এনে পড়ানো হতো। কিন্তু জনসংখ্যার আধিক্য হোক বা যে কোনো কারণে হোক মাদ্রাসায় এখন বিপুল সংখ্যক ছাত্রী থাকেন। সে কারণে লোলুপ শিক্ষকদের সুবিধাই হয় বেশি।
একটা সময় যখন দেশে ধর্ষণ আরো বেড়ে গিয়েছিল বা জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা ঘটেছিল তখন একশ্রেণির কুলাঙ্গার রব তুলেছিল ‘পোশাকের’ কারণে মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু এখন কী বোঝা যাচ্ছে? মাদ্রাসার ছাত্রীরাতো হিজাব, বোরকা পরেই থাকেন। তবুও কেনো তারা নিপীড়নের শিকার হন। কেনো কন্যা শিশু নিপীড়নের শিকার হয়? এসব বলা মানে এই নয় যে মাদ্রাসা শিক্ষকের সবাই খারাপ। দরদি, বাৎসল্য বা ভালো শিক্ষকের সংখ্যাই হয়তো সেখানে বেশি। কিন্তু খারাপের আড়ালে ভালোটা চাপা পড়ে যায়।
বিজয়লক্ষ্মী নারীরা যেমন পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের উৎসাহ প্রেরণা দিয়ে থাকেন তেমন সমাজের অংশীজন বা সচেতন নাগরিক হিসেবে পুরুষদেরও উচিত তাদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে সামিল হওয়া। যখন নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেন আমাদের উচিত তাতে সামিল হওয়া। কিন্তু আমরা তা হই না বা এড়িয়ে যাই। মানুষের মধ্যে সচেতনা তৈরি করতে হবে ভীষণভাবে। পাল্টাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি। নারীরা এখন বিশ্বে এগিয়ে চলছে তাদের কর্মে, সৃজনে। তাই ফতোয়া দেয়ার বই না খুঁজে তাদের সেই অগ্রযাত্রায় হতে হবে সামিল।
ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা সেই স্বাধীনতা হয়তো ব্যক্তির রয়েছে কিন্তু সমাজের চোখে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্যও প্রয়োজন বাস্তবিক শিক্ষা। এতো বাধার পরও কিন্তু প্রতিবাদ যে হচ্ছে না তা নয়। অতীতে অনেক নারী জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করে গেছেন। সম্প্রতি উদাহরণ হয়ে আছেন নুসরাত। এর মধ্যেই চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে মসজিদের ইমামের বিরুদ্ধে কলেজ ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ উঠলে তার চোখে মরিচের গুঁড়ো ঢলে দেন ওই ছাত্রী।
শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে একটি মেয়েকে টিজ করার কারণে এক মোটরসাইকেল আরোহীকে গণপিটুনি দেয়া হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর কারণে আটক হয় বখাটে। এমন ঘটনা আরো ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ছে ভণ্ড পুরুষদের। বেরিয়ে আসছে মুখোশ। নারীরা আরো সাহসী হয়ে উঠছেন। কিন্তু এসবতো রাস্তাঘাটের উদাহরণ। যেখানে নারীর বিশ্বাস জন্মে সেখানে যেন তিনি নিরাপদ থাকেন তা নিশ্চিত করতে হবে।
শুধু আইন থাকলে হবে না প্রয়োজন কঠোর প্রয়োগ। নুসরাত হত্যার প্রতিবাদ বা বিচার চাইতে গিয়ে দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষ বিক্ষোভে বা মানববন্ধনে যেটি বলেছেন তা হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিশু বা নারীদের প্রতি সহিংসতা নতুন নয়, হয়তো আরো ঘটবে আগামীতে। কিন্তু তা রোধ করতে পারে একমাত্র আইনের কঠোর প্রয়োগ। এই যেমন কঠোরতার কারণে এখন ‘এসিড সন্ত্রাস’ নেই বললেই চলে।
ধর্মীয় শিক্ষকরা তাদের শ্রদ্ধার আসনটি হারাতে বসেছেন তার কারণ তাদের নৈতিকস্খলন। যেটিই আগে ছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার, গর্ব করার বিষয়। বিবেকবোধের কারণে সমাজ তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন আর এখন দেখেন ঘৃণার চোখে। কারণ তাদের একটি অংশ ধর্ষণ, বলাৎকারের মতো ঘটনার সাথে অভিযুক্ত বা জড়িত। এ থেকে মুক্ত হতে না পারলে তার প্রভাব পড়বে পুরো সমাজেই।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/জেআইএম