আমরা কেন ভুলে যাই?
ভুলে যাওয়ায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আবার বলা যায় এতো ঘটনা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ঘটে যে আমরা ভুলে যেতে বাধ্য হই বা ঘটনার পরম্পরা আমাদের ভুলে যেতে বাধ্য করে। ছোট থেকে এ বয়স পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে এতো কিছু ঘটে গেছে যে আঙ্গুলে গুণে সবকিছু এখন আর বলতে পারবো না।
সকালে যে ঘটনায় আমরা চায়ের কাপে ঝড় তুলি বিকেলেই সে ঘটনার উপর আস্তরণ ফেলে অন্য কোন ঘটনা।পুরোনো ঘটনার চাপটা থেকে গেলেও নতুন ঘটনা নিয়ে আমরা আলোড়িত হই। পেছনে পড়ে থাকে পুরনো ঘটনা, হারিয়ে যেতে থাকে সঠিক শাস্তি বা বিচারের সম্ভাবনা।
যদি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির ঘটনা থেকেই শুরু করি তাহলে তো ৭ টি বছর ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ঝরে গেছে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেধে দেয়া ৪৮ ঘন্টা শেষ হয়ে কত শত ঘন্টা চলে গেলো। ছোট্ট মেঘ শিশু থেকে কিশোর হলো। আমরা কি বিচার পেয়েছি?
ক্যান্টনমেন্ট থেকে উদ্ধার করা তনুর লাশ নিয়েও আমরা বিচার পাওয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। বিচার কি পেয়েছি? মিতুকে তো আমরা ভুলেই গেছি। এমনি ধর্ষণে ঘটনা অহরহই ঘটছে। এমনকি ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা দু’বছরের শিশুও। আর মাদ্রাসায় অনৈতিক কার্যকলাপের কাহিনী তো নতুন নয়। পত্র-পত্রিকা চোখ রাখলেই প্রতিদিন মাদ্রাসার এমনি ঘটনায় চোখ যায়। নুসরাতের মৃত্যুর পরও চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন অক্সিজেন এলাকার ওয়াজেদিয়া মাদ্রাসা থেকে এক ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়েছে।
রাজধানীর ডেমরায় নুর-ই মদিনা মাদ্রাসার ছাত্র শিশু মো. মনির হোসেনকে মুক্তিপণের জন্য মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এবং মসজিদের ইমাম দুই ছাত্রকে নিয়ে মনিরকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। এবং মাদ্রাসা ছুটির পর মনিরকে অপহরণ করে নির্মাণাধীন মসজিদে নেওয়ার সময় মনির কান্নাকাটি শুরু করলে একজন শিশুটির মুখ চেপে ধরে তখনও মনির চিৎকার করলে শিশুটির চোখ ও মুখ গামছা দিয়ে বাঁধে। তখনই মনির মারা যায়।
এ সময় মনিরের লাশ বস্তায় ভরে মসজিদের সিঁড়িতে পাশে রেখে দেয়। অপরাধীদের সাহস ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে সমাজে বাড়ছে নৃশংসতা।
নুসরাতের শরীরের অশি ভাগ পুড়ে গিয়েছিলো। শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিলো নানা ধরনের সংক্রমণ, অচল হয়ে আসছিলো হার্ট, কিডনি, ফুসফুস। নুসরাত বাঁচতে চেয়েছিলো, লড়াই করতে চেয়েছিলো, শাস্তি দিতে চেয়েছিলো অপরাধীদের। কিন্তু নুসরাত লড়াই শেষ করতে পারলো না। ছোট্ট একটি প্রাণ ফুল হয়ে ফুটে উঠতে পারলো না তার নিজের আবহে।
কোনো বৃষ্টির দুপুর তার ভালো লেগেছিলো? শীত আসি আসি দিনে ভালোলাগায় ভরে উঠতো তার কিশোরী মন? কাচের চুড়ি ভালোবাসতো মেয়েটি? বই পড়তে ভালোবাসতো? গান গাইতে? না, এসব প্রশ্নের উত্তর জানা হবে না কারো কোনোদিন। নুসরাতের সমস্ত ভালোলাগা আর স্বপ্ন তার আশি ভাগ পুড়ে যাওয়া শরীরের মতোই ছাই হয়ে গেছে।
অথচ এ ঘটনাও ভুলে যেতে আমাদের সময় লাগবে না। আমাদের ক্ষতস্থানে প্রলেপ পড়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। কারণ আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এক একটা ঘটনা ঘটে আমরা রাস্তায় দাঁড়াই। আন্দোলন করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে ঝড় তুলি। কিন্তু শেষে কিন্তু বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। সময় যেতে যেতে আমরা একটা সময়ে সব ভুলে যাই।
কী বলবো এই ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে? হুজুগ না অঘটন ঘটার অতিমাত্র? খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, প্রতারণা-কী নেই আমাদের প্রতিদিনের মেন্যু কার্ডে? অবাক হয়ে ভাবি, তাহলে কি সব অপরাধের বিচার হতে সামাজিক চাপের প্রয়োজন পড়ে? আইন তার নিজের গতিতে চলবে না! চলাই তো উচিত। কিন্তু অনেক কিছুই চোখের আড়াল থেকে পর্দার আড়ালে চলে যায়।
সমাজ অস্থির। সমাজের মানুষগুলোও তাই। চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের অস্থির করে তুলেছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি প্রয়োজন। প্রয়োজন নিজেদের সচেতনতা। অপরাধের বিচার এবং শাস্তির জন্য দাবি তোলা উচিত জোরালো কণ্ঠে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় বহু অপরাধ এবং অপরাধীর সাজা এখনো হয়নি।
অপরাধীরা অনেকক্ষেত্রে রয়ে গেছে বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে। অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে অপরাধ এবং অপরাধীদের আমরা আটকাতে পারবো না। খুন, ধর্ষণ আর অনৈতিক অপরাধের বেড়াজালে মুখথুবড়ে পড়বে গোটা সমাজ।
ক’দিন পরেই আরেকটা ঘটনা সামনে এসে দাঁড়ায় আমরা তখন পূর্বের ঘটনা বাদ দিয়ে নতুন ঘটনার জন্য তৎপর হই। এভাবেই দিন গড়িয়ে যায় আমরাও এগিয়ে যাই পুরাতনকে পেছনে ফেলে। ভুলে যাই সমাজে ঘটে যাওয়া একের পর এক দুর্ঘটনা আর নৃশংসতা।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস