বাঙালি মননের সাংস্কৃতিক আড়ম্বরতা
দেশের সংস্কৃতি বলতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশের গণমানুষের সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, ভোজনরীতি, পোশাক, উৎসব ইত্যাদির মিথষ্ক্রিয়তাকে বোঝানো হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির থেকে ধার করা কিংবা প্রভাবান্বিত। তবুও স্বকীয় কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আলাদা করার প্রয়াস পাওয়া যায়। বাংলা ভাষা যখন ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি তখনো এখানকার মানুষের নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাস, আচার, ধর্ম, ধর্মকে কেন্দ্র করে উৎসব, পার্বণ সব কিছুই ছিল। এটা ঠিক যে, সংস্কৃতি কখনো এক জায়গায় স্থির থাকে না।
সংস্কৃতি চলমান প্রক্রিয়া। জানায় বা অজানায়, চেতনে বা অবচেতনে প্রতি মুহূর্তে সংস্কৃতি বদলায়। কিন্তু এই বদলে যাওয়ার ধরন কখনো এতো নীরবে, নিঃশব্দে ঘটে যে টের পাওয়া মুশকিল; আবার প্রকাশ্য রূপ লজ্জাকর, যা নিজ সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। বাঙালির চিন্তায়, মননে ও কর্মে এখন চরম ব্যস্ততা আসন্ন পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক প্রস্তুতি নিয়ে। প্রতি বছরই বৈশাখ এলে আমাদের ঘুমন্ত বাঙালিয়ানা জেগে ওঠে। কিছুদিন প্রাণচঞ্চলতা থাকার পর বাঙালির বাঙালিয়ানা বৈশাখ যেতে না যেতেই ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। এরপর থেকে শুধু দেশি মুরগি ছাড়া বাকি সব কিছুতেই বিদেশি খোঁজার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় আমাদের।
যে কোন দেশের সব প্রচলিত প্রথাই হচ্ছে সংস্কৃতির অন্যতম পরিচায়ক। বিবর্তন একটা প্রমাণিত সত্য। সময়ের বিবর্তনে বর্তমানে আমরা Z বা I প্রজন্মে বাস করছি। এই প্রজন্মের সন্তানদের চিহ্নিত করা হয় Z বা I প্রজন্ম নামে। এরা (Y, Z বা I প্রজন্ম) সব দিক দিয়ে এগিয়ে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এরা সেরা। তথ্যের আদান-প্রদানে এদের জুড়ি মেলা ভার। বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মিশ্রণ এদের মধ্যে প্রচণ্ড। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সম্মান ফাইনাল সেমিস্টারের ছাত্রী ইরা তাদেরই একজন। আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির আগামীর ধারক। কথাবার্তায় আজকাল তার ইংরেজি সংমিশ্রণে অশুদ্ধ বাংলায় কথা বলা স্বভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। মোবাইল ফোনে দুলাভাইয়ের ফোন নাম্বার তার সংরক্ষণ করা আছে হিন্দিতে “Jiju” দিয়ে। টিভি দেখতে বসলেই তার প্রথম পছন্দ হিন্দি সিরিয়াল বা মুভি (যার বেশির ভাগই পরিকীয়াকেন্দ্রিক)।
পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্য বই তো পড়াই হয় না, মধ্যে মধ্যে পত্রিকা বা ম্যাগাজিন হাতের কাছে এলেই সরাসরি চলে যাওয়া চাই বিনোদন বা সাজ-সজ্জার পাতায়। সার্বক্ষণিক সঙ্গী ফেসবুক তো থাকছেই। শত শত বন্ধু তার ধাক্কাধাক্কি করে ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগতে। অন্যদিকে গৃহিণী লিরা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর পাঁচ অনুষ্ঠানের স্বার্থকতায় সবর্দা ব্যস্ত। বিয়ের পাঁচ অনুষ্ঠান- ‘‘আখদ, মেহেদি, ফিরানি, রিসেপশন ও বিদায়” প্রত্যেকটাতে ভিন্ন ভিন্ন পোশাক ও সাজ তার বাধ্যতামূলক। সারাক্ষণ কে কি রঙের, কোন ডিজাইনের পোশাক পরেছে তা নিয়ে চলে তাদের আলাপচারিতা। কখনও কোন শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ বা বইমেলায় নয়; ইদানিংকালের টাকা হাতানো নতুন হুজোগ Food Fair এ তাদের যাওয়া চাই।
প্রত্যেক অনুষ্ঠানের হাজারটা সেলফি সম্বলিত ফেজবুক হালনাগাদ তো একটা বদঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একেক ছবিতে মুখের একেক ধরনের ভঙ্গিমা। কখনো ঠোঁট সুচোর মতো, কখনো বাঁ দিকে আবার কখনো ডান দিকে বাঁকানো। দুবাই থেকে ইংরেজিতে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করে আসা মীরা চকবাজার উচ্চারণ করতে গিয়ে বারবার কক্সবাজার বলে ফেলে। নিজের দেশের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রতি কোন আসক্তি নেই তার। অধিকন্তু বিদেশ ঘুরে বেড়াতেই তার শখ। সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ। বিভিন্ন যাত্রাপথে পাশে বসা সহযাত্রীর সাথে কৌশল বিনিময় করে কালক্ষেপণে সময় হয় না তার। সারাক্ষণ কানে এমপি থ্রি আর হাতে ফেসবুকিংয়ে ব্যস্ত থেকে গন্তব্যে পৌঁছাটাই জরুরি যেন।
বলাবাহুল্য যে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কোন দায়-দায়িত্ব এদের মধ্যে নেই। জীবন যে একটা দর্শন, জীবনের যে একটা দর্শন আছে সেই বোধ এদের মধ্যে নেই। এরা কখনো আত্মীয়-স্বজন বা সমাজের কোন অস্বাভাবিকতা, অভাব, রাজনৈতিক বিচ্যুতি বা গণদুর্ভোগ নিয়ে কথা বলে না। কাজিনরা বা বন্ধুবান্ধব একত্রিত হলে শুধু পরিকল্পনা করে পার্টি করার, কথা বলে পোশাক-আশাক, খাবার-দাবারের। গর্ব করে ফ্ল্যাট বা জায়গা জমি কেনার, গাড়ি কেনার, কাবিননামা কার কতো বেশি, কার বিয়েতে কতো বেশি খরচ করা হয়েছে প্রভৃতি বিষয়ের। এরা মানবতার কথা বলে না, দেশপ্রেমের কথা বলে না, বলে না মূল্যবোধের কথা, করে না কোন সাহিত্যালোচনা।
এরা কোন সামাজিক বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততার কথা ভাবে না, বলে না এবং সম্পৃক্ত নয়। পারস্পরিক পারিবারিক সম্পর্কও কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ, ছাড়া ছাড়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ধরনের। এরা কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পরগাছা। আমাদের সময় আমরা বিদ্যালয়গুলোতে স্কাউট করতাম। পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব করতাম। সেই সব ক্লাব বা সংগঠন থেকে প্রতিবেশী ও সমাজের জন্য নেওয়া হতো নানা উদ্যোগ। গরিব শিক্ষার্থীদের পড়ানো হতো বিনে পয়সায়। বিভিন্ন দূর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সহায়ক সহযোগিতা করা হতো সবার। হতো নানা ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। এখন আর এসব দেখা যায় না।
আমরা দেখেছি স্কুলগুলোতে বিভিন্ন বেসরকারি বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি দল গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষাতো কীভাবে ঘরে খাবার স্যালাইন বানানো যায় এবং সেই শিক্ষা পরিবার, গ্রাম বা সমাজের সবাইকে শেখানোর কথা বলা হতো। অন্যান্য প্রতিনিধি দল আসতো নিরাপদ স্যানিটেশনের পদ্ধতি শিক্ষাতে। আমরাও সেভাবে সমাজের সব স্তরে সে শিক্ষা সেবায় নিয়োজিত থাকতাম। আমাদের সময় সবার সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ছিল অনেক বেশি। বিভিন্ন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে যুবসমাজের সম্পৃক্ততা ছিল প্রয়োজন মতো। আমাদের সময়ে একই পরিবারের, একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, একই সমাজের বড়-ছোট ছিল পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বশুলভ, সম্মান ও সহমর্মিতার সম্পর্ক।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পারস্পরিক সহাবস্থানের ফলে এখন জাতিগত বিদ্বেষ (হিন্দু-মুসমাল ব্যবধান) কমেছে। তবে বেড়েছে পেটি বুর্জুয়া সমাজের আধিপত্য। ফলে বেড়েছে বড়লোক-ছোটলোকের অপসংস্কৃতি। সবাই এখন শহুরে বিলাসী জীবনযাপন আর ধার করা বিদেশী সংস্কৃতিতে আসক্ত। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার আগ্রাসন আর সাংস্কৃতিক পরিগ্রহণে সবাই এখন বুঁদ হয়ে আছে খেই হারিয়ে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাবু সেজে দল বেঁধে ঘরের বাইরে খাবারের প্রবণতা বেড়েছে। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে টংয়ের দোকানের মতো মানহীন শত শত রেস্তোরাঁ। কত লোক গৃহহীন, কত শিশু অনাহারে তা এখন আর কাউকে ভাবিত করে না। শহরে এখন মেজবানের ধরনে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
এখন কর্পোরেট মোড়কে মেজবানের দাওয়াত পায় পেটি বুর্জুয়ার দোসর কর্পোরেট সাঙ্গপাঙ্গ মাত্র। মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে বিকিকিনি হতে শুরু করেছে বাঙালি ঐতিহ্যের সার্বজনীন অনুষ্ঠান পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা। বাঙিলিয়ানার আসল রূপ হারিয়ে তা আজ বেশভুষা ধরেছে আধুনিকতা আর কর্পোরেট মোড়কের পান্তা-ইলিশে। কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার বিদেশী সংস্কৃতির অনুকরণে সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। বাঙালির অস্তিত্বের নির্দেশক ২১শে ফেব্রুয়ারির মতো শহীদ দিবস আজ আমরা উদযাপন করা শুরু করেছি ।২১শে’র প্রথম প্রহরে বোমা ফাটিয়ে উৎসবের মধ্যে দিয়ে যা বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় দৃশ্যমান। অধিকন্তু ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ও ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যকার পার্থক্য না বুঝে ২১শে’র চেতনাকে গুলিয়ে ফেলেছি ৭১’র মুক্তি ইতিহাসের সাথে ভুলে ভরা প্রচারণায়।
সব গাছ সব মাটিতে হয় না, সব মাছ থাকে না সব নদীতে। উপযুক্ত পরিবেশ লাগে। জলবায়ু, তাপ ইত্যাদি ঠিকমতো হতে হয়। একটা জাতির চিন্তার জগৎটিও অনেকটা সেরকম। ওটা কীভাবে বিকশিত হবে তা নির্ভর করে সে জাতির ধ্যানধারণা ও রীতিনীতি, সংস্কৃতি, এবং প্রাণশক্তির (সু) শিক্ষার ওপর। অনুকূল পরিবেশ পেলেই একটা জাতির মেধা প্রস্ফুটিত হতে পারে শতমুখী সৃজনশীলতায়।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]
এইচআর/জেআইএম