ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কাঁচের ভালো বাসা

নাসরীন মুস্তাফা | প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ০৫ এপ্রিল ২০১৯

পুরনো ঢাকায় আগুন-কাবাব হয়েছিল মানুষ, রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে ফেলার প্রত্যয় ঘোষিত হ’ল। কাজটা তুলনামূলকভাবে সহজ। নতুন শহরের বাসিন্দারা চাইলেই বদলে যাবে পুরনো ঢাকা, বদলাতে বাধ্য। এরকমটা ভেবে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল নতুন ঢাকা। কেননা, নতুন তো নতুন। ঝকঝকে, তকতকে। বিপদ এখানে সহজে ঘটে না। সম্ভাব্য বিপদ যেটা, সেটা তো ভূমিকম্প? ভূমিকম্প সহনশীল রডের বিজ্ঞাপন টিভিতে হরহামেশা দেখায়, চিন্তা নেই নিশ্চয়ই।

কিন্তু না। নতুন ঢাকায় আগুন-কাবাব নয়, কাঁচে ঘেরা সুউচ্চ ভবনের ভেতর আগুন লেগে স্রেফ ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে মরতে হয়েছে মানুষকে। বিপদের সময় একটু বাতাসের জন্য কাঁচের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে মরিয়া ছিলেন জীবন-যোদ্ধারা। পুরো ভবনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁচের সাঁজ, প্রতি মুহূর্ত যখন জীবনের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে যায়, তখন সহজ হয়নি কাঁচ ভেঙ্গে বাঁচাটা। করুণ মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়েছে।

কেন এমনটি ঘটল, কি হলে কি হ’ত না, তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। সাথে জমা হচ্ছে আরও বড়ো আশংকা। আগুন যেমন পুরনো ঢাকা-নতুন ঢাকার পার্থক্যকে চেনেনি, ভূমিকম্পও চিনবে না। প্রতি সেকেন্ডে নড়ছে ভূমিতল। সেই কাঁপুনি সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকে জাগতিক জীবন। সহ্য না হলে ধপাস্! কাঁচে ঘেরা ভালো বাসা দুমড়ে মুচড়ে যাবে, কাঁচ ছিটকে যাবে চারিদিক, তীক্ষ্ণ ছুরির মতো এসে লাগবে গলায়-বুকে-চোখে-সব খানে।

নোবেল পুরস্কারবিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগমান একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আকাশ ছোঁয়া ভালো বাড়ির রাগ দেখেছেন কখনো?’ প্রতি বর্গ ইঞ্চি কাঁচ ভাঙ্গছে আর আমি সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছি, এমন দৃশ্য দেখার ইচ্ছে কার আছে? বাঁচতে ভালোবাসে সবাই, তাই না? আর বাসে বলেই ভাবে, কাঁচে বাড়ি ঘিরে দিলে সহজে বদলে নেওয়া যায়, আর দেখতেও কেমন জাতে ওঠা লাগে বেশ। প্রখর সূর্যতাপ ছিটকে যাচ্ছে কাঁচের গায়ে, পথচারীদের চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখাও আনন্দের।

আর কাঁচের ভালো বাসার ভেতর এসি ছেড়ে দিলেই তো আভিজাত্য বেড়ে গেল দ্বিগুণ। ঠাণ্ডা বাতাসে মাথা খোলে বেশ। তখন আয়েশ করে ভাবা যায় বৈশ্বিক ঊষ্ণতা রোধের উপায়গুলো। এখন তো গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে কথা বলা বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠার মোক্ষম উপায়। একদল বলছেন, বিশ্ব গরম হয়ে উঠছে। আরেক দল বলছেন, বিশ্ব গরম হয়ে উঠলে আমার গায়ে কাঁপুনি লাগে কেন? আর সত্যটা হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে কাঁচে ঘেরা ভবনের ভূমিকা আছে, শতকরা ৪০ ভাগ শক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের জন্য দায়ী এরা। দুই দলই কিন্তু কাঁচে ঘেরা ভালো বাসাতে বাস করেন। দুই দলই কিন্তু এসি ভালোবাসেন।

আমরা আছি কাঁচ যেন কখনোই না ভাঙ্গে, তেমন প্রার্থনারতদের দলে। বিশ্বব্যাপী ধাতব ফ্রেমে কাঁচের দেয়াল বসানোর স্টাইল জনপ্রিয়তা পেয়েছে কাঁচের অন্তস্থ শক্তি, ইচ্ছেমতো ফ্রেম বসানোর স্বাধীনতা, কাঁচের সহনশীলতা আর ছোট আকারে গ্লাস-প্যানেল পরিবহনের সুবিধার কারণে। আর ভয়াবহ ভূমিকম্পে এখনো কাঁচে ঘেরা আধুনিকতম শহরগুলো ভাগ্যক্রমে পড়েনি বলে কাঁচের ক্ষতি করার ক্ষমতা কতটা হতে পারে, তা পরীক্ষা করা হয়ে ওঠেনি বলে চলছে কাঁচের ভালো বাসা। কিন্তু ভূমিকম্পে কাঁচের প্যানেল এর পাশগুলোতে চাপ পায়, ধাতব ফ্রেমের সাথে সেই চাপ ভাগাভাগি করে না নিতে পারলে ভেঙ্গে পড়ার ব্যাপক ঝুঁকিতে থাকে, এ কথাও কিন্তু সত্য।

ঝুঁকি এড়ানোর নানা কৌশল নিয়ে বিশ্বব্যাপী গবেষণা চলছে, তার কতটুকু আমাদের কাঁচ-ঘরে প্রযোজ্য হয়, তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোন গবেষণা চোখে পড়েনি। ‘সবুজ স্থাপত্য’ বা গ্রিন আর্কিটেকচার কতভাবে অর্জন করা সম্ভব, তা নিয়েও গবেষণা চলছে বিশ্বময়। জলবায়ুর ক্ষতিকর ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে আছে বাংলাদেশ। কাঁচে ঘেরা সুউচ্চ ভবন কি সবুজ স্থাপত্যকে সাহায্য করছে? এ দেশে ঝুঁকিতে থাকা স্থাপত্য পেশাতে বেচারা স্থপতিকে মুখোমুখি হতে হয় ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে আসা ক্লায়েন্টের, যার সোজা বক্তব্য থাকে, ‘ওরকম বানিয়ে দেন’।

কখনো কখনো হাতে থাকে ওরকম দালানের ছবি। ইউরোপ-আমেরিকার জলবায়ু আর বাংলাদেশের জলবায়ুর চরিত্র যে এক না, পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যকে যে পরিবেশ অনুযায়ী গড়ে তুলতে হয়, সে কথা বলা এবং শোনার সময় থাকে কার? ভেতরের প্ল্যানিং যেমনই হোক, আগাগোড়া ঝকমকে কাঁচ দিয়ে মুড়ে দিতে পারলে যে ‘স্থাপত্য’ দাঁড়িয়ে যায়, তার ঢেকুর কিন্তু বেশ আওয়াজের। দুই পক্ষকেই উপহার দেওয়া যেতে পারে আলেক্স উইলসনের লেখা রিথিংকিং দ্য অল-গ্লাস বিল্ডিংস বইটি।

এরপরও যদি না পড়েন, তাই শুধু এই কথাগুলো উদ্ধৃত করছি বইটি থেকে, ‘ঐসব চাকচিক্যের জন্য চড়া মূল্যে দাম চোকাতে হয় পরিবেশকে: শক্তির ব্যবহার বেড়ে যায়। যতদিন পর্যন্ত নতুন চকমকে প্রযুক্তি আরো সহনশীল প্রাযুক্তিক সমাধান না দিতে পারে, অনেক বিশেষজ্ঞ যেমনটি বলছেন, সেভাবে সম্মিলিতভাবে আমাদের উচিত ব্যাপক চাকচিক্যের পুরোটাই কাঁচে মোড়ানো ভবন ব্যবহারের সমাপ্তি ঘটানো।’

আলেক্স মেনে নিয়েছেন, কাঁচের ব্যবহারের কারণগুলো। দিনের আলো স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে ভেতরে ঢুকছে বলে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার কমানো যায়। এরপরও দেয়ালের এক তৃতীয়াংশ কাঁচে ঢাকা হতে পারে, পুরোটা কেন? বাইরের দৃশ্য খুব ভালভাবে দেখার জন্য পুরোটা চাই? ফ্রেমের ভেতর দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখলে মানসিকভাবে দেখাটা কি আরো ভালো হয়ে ওঠে না? ইন্টেরিয়রে কাঁচের দেয়াল কর্মচারীদের ফাঁকি ধরতে সুবিধা দেয় বুঝলাম। বারান্দার রেলিং-এও কেন কাঁচ? কর্পোরেট সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ, তাই না?

ঠিক তাই। কাঁচের দেয়ালে আকাশের ছায়া চলমান, এ দিয়ে কর্পোরেট ইমেজকেই বোঝায়। স্বচ্ছ দেয়াল গ্রাহকের কাছে এমন ঘোষণাও দেয়, দেখুন আমাকে, এই যে আমি, আমাকে আপনি দেখতে পারছেন, কেননা আমি বা আমরা আপনার কাছে কোনকিছুই লুকাচ্ছি না। এই আপাত স্বচ্ছ ইমেজের মোহ বিশ্বব্যাপী ভবনকে কাঁচে মুড়ে যেতে উৎসাহিত করল। কিন্তু কাঁচে ঘেরা ভবনের ভেতরটা দেখা কি সত্যিই সহজ হয়ে গেছে? কর্পোরেট জগত কি সত্যিই স্বচ্ছ আজকাল?

আমার নিজস্ব ভাবনায় কাঁচের ব্যবহারের মূল কারণ হচ্ছে আলস্য। বাড়ির বাইরেরটা কত সুন্দর করা যেগে পারে, এ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আর শ্রম কোনটাই দরকার পড়ে না, যদি চোখ বুজে কাঁচ দিয়ে ঘিরে দেওয়া যায়। সানশেডের ডিজাইনও করা লাগে না। ওদিকে ক্লায়েন্টকে ডিজাইন ‘খাওয়ানো’ খুব সহজ হয়ে যায়। আর ক্লায়েন্ট খানও বটে গপগপ করে। পাতলা চামড়ার দেয়াল জায়গা নিচ্ছে কম, ফলে বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার মতো স্পেস পাওয়া যায় বেশি। এই নতুন তরিকার স্থপতি আর ক্লায়েন্টরা টেকসই ভবন, সবুজ স্থাপত্য ইত্যাদি শব্দের প্রচলন হতে বিপদে পড়ে গেছেন।

ভূমিকম্প ঠেকাতে হালকা কাঁচের ব্যবহারের যুক্তি পাওয়া গেলেও আগুনের ক্ষেত্রে কি হবে, তা নিয়ে নতুন চিন্তা শুরু হয়ে গেছে কিন্তু। বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে কাঁচ ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকির সাথে আলোচিত হয়েছে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়া, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়াসহ উদ্ধারকাজে ঝামেলা তৈরি হওয়ার মতো অনেক কিছু। আগুন-নিরাপদ উপাদান বা উদ্ধারকাজে কাঁচের মতো উপাদানের গুরুত্ব এত কাল মোটেও ছিল না। কোন্ ভবনে কতটুকু কাঁচের ব্যবহার হবে, ভবনের বাইরের উপাদান আগুন ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সক্ষম হবে, আগুন ছড়িয়ে পড়লে উদ্ধার কাজে সহায়তা করার স্পেস থাকতে হবে ইত্যাদি ভাবনা অবশ্যই দরকার।

টেকসই উন্নয়নের যুদ্ধে ভবনকে হতে হবে কম পানির ব্যবহার, ঠিক যতটুকু হলে না, ততটুকু শক্তির ব্যবহার, প্রাকৃতিক শক্তির সংরক্ষক, কম বর্জ্য উৎপাদন এবং ব্যবহারকারীর জন্য স্বাস্থ্যকর স্পেস দিতে সক্ষম, এমন ভবন। পরিবেশ বুঝে নিশ্চয় এর ভাষা ভিন্ন হবে। তাহলে পাশ্চাত্যের ভবন দেখে সেরকম ভবনের কপি আমাদের এখানে করতে হবে না। এর অনেক সমাধান কিন্তু আমাদের চিরায়ত স্থাপত্যের ভাষাতেই লুকিয়ে আছে। নতুন করে সেই ভাষা আত্মস্থ করার দরকার আছে কি না, সেই ভাবনাটা সত্যিই আজ জরুরি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/এমকেএইচ

আরও পড়ুন