যে মরে সে-ই দায়ী?
আবাসিক, বাণিজ্যিক সব ভবনেই অগ্নিনিরোধ ব্যবস্থা রাখার কড়া নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেইসঙ্গে রাজধানীতে চলছে ভবন তৈরি ও নিরাপত্তা ত্রুটি খতিয়ে দেখার কাজ। কোনো অঘটনের পর এভাবেই চলে আসছে নির্দেশ, সতর্কতাসহ নানা অ্যাকশন।
একের পর এক অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন ঘটনায় হতাহতের বিষয় নিয়ে কিছুদিন চলে মাতামাতি। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। সুপারিশ আসে অসংখ্য। দেয়া হয় ক্ষতিপূরণও। সরকার মরা-আধমরাদের জীবনের দাম ঠিক করে দেয়। নিহত-আহতদের লাখ-হাজার টাকার অংক ধরার মধ্যে। জীবন্তদের দাম পয়সায়ও পড়ে না। ক’দিন পর আরেকটি ঘটনায় শুরু হয় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে পুড়ে ৭১ জনের কয়লা হওয়ার রেশ না কাটতেই বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড। আরও ২৬/২৭ জনের প্রাণহানি। এর মাঝে গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের পাশের কাঁচাবাজারে আবারও অগ্নিকাণ্ড।
দু’বছর আগে ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি এই বাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর অগ্নিনির্বাপণে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সুপারিশ করেছিল ফায়ার সার্ভিস। এমনকি ব্যবস্থা নিতে চারবার নোটিশও দেয়া হয়েছে। কিন্তু, তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফায়ার সার্ভিসের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ৮৯ হাজার ৯২৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮ হাজার ১৩টি ঘটনা ঢাকা শহরেই।
২০১৭ সালে ডিএনসিসির মার্কেটটিতে অগ্নিকাণ্ডের পর গুলশান, বনানী ও বারিধারার বাণিজ্যিক ভবন, ব্যাংকের কার্যালয় ও হাসপাতালের অগ্নিঝুঁকি নিরূপণ করে ফায়ার সার্ভিস। এই তিন এলাকার ২০১টি ভবনের অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলার সক্ষমতা নেই। এর মধ্যে রয়েছে ৪৬টি বাণিজ্যিক ভবন। যার ২১টি বহুতল ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিভিন্ন ব্যাংকের ১০৮টি কার্যালয়ের মধ্যে ১০৪টিকে অতিঝুঁকিপূর্ণ। ১২টি হাসপাতালের ১০টিরই অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলার সক্ষমতা নেই।
শুধু শিল্প, বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবন নয়; রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার কিছু হাসপাতালও রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। কিছুদিন আগে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পর নতুন করে আলোচনায় আসে বিষয়টি। ২০১৬ সালেই রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল, ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল, রাজশাহী মেডিকেল বা রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পূর্বাপরেও হাসপাতালগুলোকে অগ্নিঝুঁকি নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। প্রকাশ করা হয়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালের তালিকাও। কিন্তু তেমন আমল মেলেনি। রয়েছে বিরক্তির ঘটনাও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল ৬১০টি। আর বেসরকারি চার হাজার ৫৯৬টি। আর দমকল বাহিনী ২৪৮টি হাসপাতালকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ১৭৪টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা বেশ দীর্ঘ। এর মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধু, ঢাকা মেডিকেল, সলিমুল্লাহ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় হৃদরোগ, মানসিক স্বাস্থ্য, চক্ষুবিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স, অর্থোপেডিক ইনস্টিটিউটের নাম।
তালিকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয় জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতালকে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও সতর্ক করা হয়েছিল। সতর্কবার্তার পরও তারা একাধিক চিঠি দিয়েছে হাসপাতালগুলোকে। মাস কয়েক আগেও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপক মহড়া হয়েছে। কিন্তু সতর্কতা বা কাজের কাজ বড় বেদনাদায়ক।
হত্যার যাবতীয় ব্যবস্থা রেখে পরে একে নিহত বলে চালিয়ে দেয়া তামাশার নামান্তর। নিমতলী, চকবাজার, বনানী, তাজরীনের মতো অগ্নিকাণ্ডে কেউ মারা গেছেন না বলে খুন হয়েছেন বলা বেশি যুক্তিসই। প্রতিটি হাইরাইজ বিল্ডিং আর ঘিঞ্জি পাড়া এক একটা ঘুমন্ত মৃত্যুকূপ- এরা এভাবে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে তাদের অস্তিত্বই জানান দিয়ে যায়। এক একটা মর্মান্তিক ঘটনার পর আমরা কুতর্কের প্রতিযোগিতায় নামি। কথাশিল্পের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলে বসি।
স্বাধীনতার চার দশক পরে একটি সক্ষম ফায়ার ব্রিগেড যেমন থাকা প্রয়োজন, নিজস্ব একাধিক স্যাটেলাইট থাকাও জরুরি। অথচ বনানীর ঘটনার পর কেউ কেউ এমনভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ছেন স্যাটেলাইটের টাকা দিয়ে আধুনিক ফায়ার ব্রিগেড গড়া হলো না কেন? প্রায়োরিটি সত্বেও প্রশ্ন তোলা উচিত ছিলো আধুনিক ফায়ার ব্রিগেড নেই কেনো।
ফায়ার ব্রিগেড আধুনিক হলেই অগ্নিকাণ্ড থামানো যেতো, মৃত্যু রোখা যেতো- এ বিশ্বাস অযৌক্তিক। আধুনিক ফায়ার ব্রিগেড অবশ্যই প্রয়োজন, এ দাবির সাথে বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই। কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। যানজট নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত কিভাবে পৌঁছাবে?
যানজটের কারণে সময়মত হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারায় বার্ষিক কতজনের মৃত্যু হয়- এসব তথ্য আছে কারো কাছে? নয়তলার ওপর ভবন করতে গেলে রাজউকসহ কমপক্ষে দশটি সরকারি সংস্থার ছাড়পত্র লাগে- এই ছাড়পত্রের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রও আছে। বনানীর এফআর টাওয়ারের মত ভবনগুলো কিসের ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রসহ অন্যান্য ছাড়পত্র পায়? ঢাকা শহরের অধিকাংশ হাইরাইজ বিল্ডিং নিয়ম মেনে নির্মাণ করা হয়নি- এর দায়ে রাজউকের কতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা আবাসিক এলাকার বদলে কেন এখন বাণিজ্য নগরী? একবারও ভাবিনা সবকিছুর ভার বহনে আমার শহর প্রস্তুত কিনা? আর অস্বস্তিকর এই সব দেখবে কে? মনিটরিং করবে কে? পরিবেশ, সিটি, ফায়ার, রাজউক, ওয়াসা, ডেসা সেবাখাতের অভাব নাই। অভাব সিস্টেমের ও মনিটরিং, আর জবাবদিহিতার। কাজে দক্ষ লোকের অভাব থাকলেও আ-হা বেশ বেশ বলার লোকের অভাব নেই। এখন ইতিবাচক আলোচনা-সমালোচনা কেউ শুনতে চায় না।
যে কোনো দুর্ঘটনায় জড়ো হওয়া উৎসুক জনতার দর্শক ভূমিকা, সেলফিবাজি নিয়ে কথা আছে। আবার এই উৎসুক জনতাই মানুষের প্রাণ রক্ষায় আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন তুচ্ছ করে। প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমন একাধিক দৃষ্টান্ত আছে- যেখানে অভিজ্ঞ ফায়ার সার্ভিস প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে বিলম্ব করেছে, উৎসুক জনতা ওই প্রতিকূলতাকে পাত্তা না দিয়ে উদ্ধার কাজ চালিয়েছে।
বেশ ক'টি ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা সমাপ্ত করা সত্বেও সাধারণ মানুষ উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। কুতর্ক আর উন্নয়নের সাফাই অনেক গাওয়া হয়েছে, হাত তালিও বেজেছে প্রচুর। এসব চলতে থাকলে আগুনে পুড়ে, পানিতে ডুবে, রাস্তায় পিষ্ট হয়ে বা গুমে-ক্রসফায়ারে মরা আর মারা চলতেই থাকবে।
কেবল বিলাপ করে নিরাপদ-বাসযোগ্য পরিবেশ আশা করা যায় না। এ নীরবতায় ঘরে-রাস্তায়- নদীপথে- পড়ার টেবিলে অফিসে, মাঠে-ঘাটে মৃত্যুর মিছিল বড় হতেই থাকবে। সেইসঙ্গে চলতে থাকবে তদন্ত কমিটি, ক্ষতিপূরণ, ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারিসহ এটা-সেটায় বুঝ দেওয়ার মৌসুম।
গত কয়েক দশক ধরে শাসকদের সীমাহীন উদাসীনতা-এডহক ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের মানসিকতা, কিছু মানুষের লোভ আর নাগরিকদের বিরাট একটা অংশের দায়িত্বহীন আচরণ বিপর্যয়কেই অনিবার্য করে তুলেছে। এর পরিণতিতে ‘মৃত্যু’ই এখানে মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়ে উঠছে। যারা মরেন শেষ পর্যন্ত তারাই দায়ী হচ্ছেন। হতেই থাকবেন।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম