ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আগুন এবং আশঙ্কার কথা

আবিদা নাসরীন কলি | প্রকাশিত: ০১:০৩ পিএম, ০২ এপ্রিল ২০১৯

চারদিকে এখন শুধু আগুনের কথা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখানে আগুন লেগেছে, ওখানে আগুন এমন খবরে এখন সবাই আতঙ্কিত। আমি নিজেও শঙ্কিত।

গত দু-তিনদিনে বারবার চুলার কাছে গিয়ে চুলা নিভানো কি-না দেখা, বিদ্যুৎচালিত দৈনন্দিন কাজের সামগ্রী ঠিকঠাক আছে কিনা খোঁজ করা আমার রুটিন হয়ে গেছে। আমি জানি আমার মতো এমন অনেকেই। মোটকথা ঢাকা এখন অনেকটা আতঙ্কের শহর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির বাইরে কোন মার্কেট বা হাইরাইজ ভবনে যাওয়ার ব্যাপারেও এখন সবার মনে ভয়। তবে সব মার্কেট বা সব সুউচ্চ ভবন আইন না মেনে তৈরি হয়েছে ঢালাও ভাবে তা বলা যায় না।

কয়েক মাস আগে উত্তরার নর্থ টাওয়ারের ১৩ তলার পুরোটাজুড়ে ‘বাবুল্যান্ড’ নামে বাচ্চাদের একটা খেলার জায়গা হয়েছে। অসম্ভব ভালো এবং সুন্দর পরিবেশে বাচ্চারা ওখানে খেলতে পারে। প্রতিদিন প্রচুর বাচ্চা সেখানে খেলতে যায়। কারো সঙ্গে বাবা-মা-ও যায়। যায় অন্য স্বজনরাও।

প্রতিদিন জায়গাটায় প্রচুর জনসমাগম ঘটে। ভেতরে একটা রেস্টুরেন্টও রয়েছে। বাচ্চারা খেলে, খেলার পর খাওয়া-দাওয়া করে। ওখানে প্রতিটি খেলার সামগ্রী বিদ্যুৎচালিত। ওই ১৩ তলায় ওঠার জন্য মার্কেটের দুই পাশে বেশ বড় বড় দুটো লিফট রয়েছে। একটা সিঁড়িও রয়েছে, যে সিঁড়ি দিয়ে কেবল মাত্র ৫ম তলা পর্যন্ত ওঠা-নামা করা যায়।

একেবারে গ্রাউন্ড ফ্লোরে ওঠা-নাম করার জন্য লিফট ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা নেই। একে তো ১৩ তলা তার ওপর প্রয়োজনীয় সিঁড়িটি নিচতলা অবধি নামেনি। আমার আশঙ্কার বিষয় হলো, এই অবস্থা এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কি হবে? আমি জানি না শিশুদের জন্য এই বিশাল আয়োজন করার জন্য কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন নেয়া আছে কি না? অথবা তারা নিজেরাও ভেবেচিন্তে এখানে এই খেলার জগৎ বসিয়েছেন কি না?

এদের আরেকটি শাখা আছে ঢাকার কল্যাণপুরে অনেক দিন ধরে। সেখানে আমি যাইনি তাই সেটার অবস্থা বা অবস্থান নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। তবে উত্তরা নর্থ টাওয়ারের ‘বাবুল্যান্ড’ নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

রাজউক এর উপর আমাদের ঢাকা শহরের দালান-কোঠার ভালো-মন্দ নির্ভর করে। কিছু দায়িত্ব রয়েছে সিটি কর্পোরেশনেরও। কিন্তু দিনের পর দিন দেখতে পাই সেই কর্তৃপক্ষের নীরবতা আর নিষ্ক্রিয়তা। নিকুঞ্জ দুই নম্বরে রাজউক ট্রেড সেন্টার তো শর্ষের মাঝেই ভূত। এই ভবনের চতুর্থ তলায় মাঝে মাঝেই যেতে হয় পেশাগত প্রয়োজনে।

এই ভবনের একেবারে ওপরের তলায় ঢাকা রিজেন্সী হোটেল। নিচে কয়েক তলায় ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের দোকান। এখানে একটি লিফট আছে কিন্তু প্রায় সময়ই তা বিকল থাকে। দেখা গেছে লিফট ডাকার জন্য প্রেস বাটনটিও বিকল হয়ে ঝুলে আছে অসহায়ের মতো। দেখার কেউ নেই। মানুষকে বিভিন্ন তলায় ওঠানামা করতে ব্যবহার করতে হয় একটি মাত্র এস্কেলেটর। ভবনটির সিঁড়িও বেশ সরু। কখনো যদি এই ভবনে আগুন লাগার মতো কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটে তখন পরিণতি কী হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

পুরো মার্কেটটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও কোনো কোনো ফ্লোরে এসি কাজ করে, কোথাও করে না। কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ভবনে খোলার মতো কোনো জানালাও নেই।

গত কয়েকদিনে শহরজুড়ে আগুনের তাণ্ডব দেখে সেখানেই দোকান আছে এমন একজনের কাছে জানতে চাইলাম মার্কেটে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের মজুদের অবস্থা। তিনি অসহায় কণ্ঠে জানালেন, একটা ঘরে অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম ছিলো। কিন্তু এখন অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামগুলো সরিয়ে ফেলে ওখানে দোকান ভাড়া দেয়া হয়েছে। এভাবেই গত ৩ বছর ধরে চলে আসছে। অথচ ভবনটির মালিক খোদ রাজউক কর্তৃপক্ষ। আর কত বিস্মিত হবো আমরা এই শহরের অসহায় নাগরিকরা?

ফাল্গুন-চৈত্র মাসের সঙ্গে আগুনের একটা সম্পর্ক আছে। শুষ্ক আবহাওয়া সেই সঙ্গে এলোপাথারি হাওয়া। আগুন লাগার জন্য খুবই উপযোগী সময়। আমাদের দেশে এসময়ে বস্তিগুলোতেই এমন আগুন লাগার ঘটনা বেশি দেখি। শর্ট সার্কিট, সিগারেটের আগুন অথবা যে কোনো ধরনের অসাবধানতা তৈরি করে ভয়াবহ আগুন। পরিণতি মানুষের মৃত্যু। কিন্তু এ বছর ঘটেছে একেবারে উল্টোটি।

বস্তির বদলে চকবাজার থেকে শুরু করে বনানী এবং সর্বশেষ গুলশান কাঁচা বাজারে আগুনের যে ভয়াবহতা আমরা দেখলাম তা পুরোটাই ঘটেছে আমাদের আইন না মানা এবং অসততার জন্য। তবে এক্ষেত্রে আমাদের ফায়ার সার্ভিস যে ভূমিকা রেখেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তারা তাদের সক্ষমতায় যতোটা সম্ভব করেছেন।

এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ঘটে যাওয়ার পর এই নগরের কর্তৃপক্ষরা নানান কমিটি গঠন করছেন সাড়ম্বরে। এখন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, তারা শাস্তির ব্যবস্থা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো দিনের পর দিন এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণের ঘটনা কি তাদের অজ্ঞাতসারে ঘটেছে? তাদের কর্মকর্তা কর্মচারীরা কেউ কি কিছুই জানতেন না? এতগুলো মানুষের প্রাণ যাবার পর এমন সচেতনতার মহড়াকে নগরের মানুষ কী বলবেন, সার্কাস?

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন