ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শেষ দেখা হলো না রে রাতুল

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ০১:২১ পিএম, ৩০ মার্চ ২০১৯

 

বনানীর এফ আর টাওয়ার জ্বলছে। চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগুন থেকে বাঁচতে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন কয়েকজন। কিন্তু অত উঁচু ভবন থেকে জানালা দিয়ে বের হওয়া কি অতই সহজ?

বহুতল ভবনের সেই মৃত্যুফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে কয়েকজন সানশেড ও তার বেয়ে নামার চেষ্টা করেন। সেখান থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে যে ক’জন মর্মান্তিক মৃত্যুকে বরণ করেন তাদের একজন আমার বন্ধু আমিনা ইয়াসমিন রাতুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের সহপাঠী।

নব্বই দশকে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার আড্ডার দিনগুলো চোখে ভাসছে। প্রথম তারুণ্যে আমরা ক’জন বন্ধু হাসি গল্পে পার করেছি জীবনের স্বর্ণালী প্রহর। রাতুল ছিল খুব সাহসী মেয়ে। কথায়, চিন্তা চেতনায় সময়ের চেয়ে অগ্রসর। সেই সাহসী মানুষটির এভাবে মৃত্যু অকল্পনীয়।

অগ্নিকাণ্ডে নিহত পঁচিশজনের কথা যত ভাবছি ততোই আতংকে, শোকে, বেদনায় স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমি নিজেও গুলশান ও মহাখালির দুটি বহুতল ভবনে কয়েক বছর চাকরি করেছি। সে ভবনগুলোও এফ আর টাওয়ারের মতোই। এভাবে মৃত্যু হতে পারতো আমারও। ভাবতে অবাক লাগে এসব বহুতল ভবনে অগ্নি ও অন্যান্য দুর্ঘটনা প্রতিরোধের তেমন কোন ব্যবস্থাই নেই। ফায়ার এক্সটিংগুইশার একটি করে হয়তো দেওয়া আছে প্রতি ফ্লোরে। সেগুলোও মান্ধাতার আমলের। প্রয়োজনের সময় কাজও করে না।

বহুতল ভবনের ছাদে হেলিপ্যাড নেই। নেই ফায়ার এক্সিট, ফায়ার কলার। একেকটি ফ্লোরে ছোট বড় অনেকগুলো অফিস। ভবনের ভিতরে সরু সিঁড়ি ছাড়া বের হওয়ার পথ নেই। সবগুলো অফিস থেকে সেই সিঁড়ি খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। সিঁড়িগুলোও এমন যে সেখানে আগুনের সময় ধোঁয়াতেই দমবন্ধ হয়ে মরে পড়ে থাকা ছাড়া গতি নেই। অধিকাংশ ভবনে সেই সরু সিঁড়ির মুখের কোলাপসিবল গেট আবার তালাবন্ধ করা থাকে। প্রয়োজনের সময় সেটা খোলাও যায় না।

ভবনের বাইরে দিয়ে ফায়ার এক্সিট লোহার সিঁড়িও যদি থাকতো তাও তো কিছু মানুষের প্রাণ বাঁচতো। বহুতল ভবনে কোন অগ্নি নির্বাপণ মহড়াও তো হয় না। এফ আর টাওয়ার ভবনটির অনুমোদন ছিল পনের তলার। কিন্তু বাইশ তলা পর্যন্ত করা হয়েছে অনুমোদনবিহীন ভাবে। এমন অনুমোদনবিহীন ভবন ঢাকায় অগুনতি। রাজউকের পরিদর্শকরা ঘুষ খেয়ে আঙুল ফুলে কলা গাছ হয় আর মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে থাকে সাধারণ মানুষ।

২০০৩ সালে অগ্নি নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। কিন্তু সেই আইন সম্পর্কে জানেই বা কে আর তা মানেই বা কে? এসব ভবনে আগুন লাগলে ভিতরের মানুষগুলোর অবস্থা হয় কলে পড়া ইঁদুরের মতো। মানুষের জীবন কতটা মূল্যহীন বিবেচ্য হলে এ ধরনের ভবন নির্মাণ হয়, রক্ষণাবেক্ষণহীন অবস্থায় চলতে থাকে এবং এরই জন্য মালিকদের ব্যাংক ব্যালেন্স ফুলে ফেঁপে ওঠে।

বেশিরভাগ ভবনের ম্যানেজমেন্ট বলতে কিছুই নেই। অনেকটা ভাগের মা গঙ্গা পায় না অবস্থা। কারণ একেক ফ্লোরের মালিক একেকজন। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জোড়াতালি দিয়ে ভবন বানিয়ে অনেক আগেই হাত ধুয়ে সরে পড়েছে নিজেদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে। এসব অনিয়ম দেখারও যেন কেউ নেই।

ফায়ার সার্ভিস বিভাগের উন্নত প্রযুক্তির কথাও ভাবতে হবে বৈকি। বাইশ তলা পর্যন্ত পৌঁছানোর মতো সিঁড়ি নেই ফায়ার সার্ভিস বিভাগের কাছে। পানির পাইপও নাকি ফাটা। একটি শিশু সেই ফাটা পাইপ পলিথিন দিয়ে চেপে ধরে ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তা করছে এমন দৃশ্য দেখা গেছে মিডিয়ায়। ফায়ার সার্ভিস বিভাগকে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে কার্যকর করে তুলতে হবে। লোকবলও বাড়াতে হবে। আর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দরকার আগুন থেকে বাঁচার বাধ্যতামূলক শিক্ষা। আগুন, ভূমিকম্প ইত্যাদি বিপদে মানুষ কিভাবে বহুতল ভবন থেকে বের হবে সেই শিক্ষাটা বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার প্রতিটি নাগরিকের জন্য।

চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর শোনা গেছে সরু রাস্তা, কেমিকেল গুদাম, পুরান ঢাকার মানুষজনের অজ্ঞতা ও লোভের কাহিনী। বনানীর অগ্নিকাণ্ডের পর দোষ চাপানো হবে কার ঘাড়ে? রাস্তাঘাটও সরু নয়, মানুষজনও অজ্ঞ নয়। বেনিয়মের ভবনগুলোর লাভের টাকা ঢুকছে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, মালিকপক্ষ, আর রাজউকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পকেটে। তাদের লোভের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর কত বছর চোখ বন্ধ করে থাকবে সরকার আর ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রাণ দিবে রাতুলরা?

রাতুলের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়নি। যে পঁচিশজন প্রাণ দিলেন তারাও তাদের পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে যেতে পারেননি। এই ক্ষতির কি কোন ক্ষতিপূরণ সম্ভব? প্রিয়জনের মৃত্যুর কি আদৌও কোন ক্ষতিপূরণ হয়?

আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। উন্নয়ন উন্নয়ন বলে জিগির তুললেই উন্নয়ন হয় না। সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা, তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা থাকা, তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বেঁচে থাকার সুব্যবস্থা করাই প্রকৃত উন্নয়ন। সেটা অর্জন করতেই সচেষ্ট হতে হবে। নইলে সকলই গরল ভেল।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন