ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আগুন নিয়ে খেলা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১২:৩৩ পিএম, ৩০ মার্চ ২০১৯

রাজনৈতিক দল সরকারকে উৎখাত করতে চায়, সরাসরি ক্ষমতাসীন কাউকে আঘাত করা যাচ্ছে না, তাই মানুষের গায়ে, সাধারণ মানুষের ব্যবহার করা গণপরিবহন, পণ্য পরিবহন বা সিএনজিতে পেট্রলবোমা ছুঁড়ে মারা। মানুষ আগুনে পুড়ে মরুক।

ব্যবসায় বেশি লাভ দরকার, তাই ভবনের নিচে দাহ্য পদার্থের মতো বোমা রেখে উপরে মানুষকে ভাড়া দাও, আগুন লেগে তারা পুড়ে মরুক। সুউচ্চ দেয়াশলাই ধরনের ভবন বানানো হোক, আগুন লাগলে নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না রেখে এসব অফিস ভাড়া দেয়া হোক, মানুষ পুড়ে ,মারা যাক। কারখানা বানাও, জরুরি দরজা বন্ধ রাখ, যাতে আগুন লাগলে কর্মীরা বের হতে না পারে, তারা পুড়ে মরুক। আগুন নিয়ে খেলা করছি আমরা নাকি মানুষের পুড়ে মরা দেখে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করছি?

বনানীর এফ আর টাওয়ারে আট বছর আগেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময় তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ভবনে আগুন প্রতিরোধে করণীয় কোনো নির্দেশনাই মানা হয়নি। ফলে, ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবনটিতে ফের ভয়াবহ আগুনে প্রাণ গেল ২৫ জন মানুষের।

পুরানো ঢাকার নিমতলীতে বাসাবাড়ির নিচে স্তরে স্তরে সাজানো রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন লেগেছিল দশ বছর আগে। সেবার একশ জনের প্রাণহানি হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চুড়ি হাট্টায় দশ বছরে পর সেই রাসায়নিক পদার্থ আবার কত প্রাণ চুরি করে নিয়ে গেল।

ফায়ার সার্ভিস বলছে এফ আর টাওয়ার ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তার জন্য ন্যূনতম কোনো সিস্টেম নেই। যে লিফট রয়েছে সেটিও ছোট, সিঁড়ি রয়েছে দুই ফুট আর চার ফুটের। জরুরি বের হওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এক ভবনের সাথে আরেক ভবন লাগানো অবস্থায় রয়েছে, ফলে বাকি ভবনগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এটি নতুন কোনো তথ্য নয়। খোঁজ নিলে রাজধানীর প্রায় ৯৯ ভাগ ভবনের একই দশা লক্ষ্য করা যাবে।

ঢাকার অনেক বদনাম। যানজটের শহর, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর শহর। এখন আরেক ভয়ঙ্কর দুর্নাম- যখন-তখন আগুন লাগার শহর। সব আগুনই এক সময় নিভে যায়। নিমতলি নিভেছিল, চকবাজার নিভেছিল, এফ আর টাওয়ারের আগুনও নিভল। কিন্তু থামল না কথা।

আমাদের মেয়র, আমাদের মন্ত্রীরা, সচিবরা, কর্তাব্যক্তিরা জানেন জনগণের ক্ষোভ বা হতাশা আর কয়েকদিন পরেই প্রশমিত হয়ে যাবে, নতুন কোনো বিপর্যয় বা উৎসব এসে এসব বেদনাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। তাই তারা কেবল কথা বলেন, প্রতিশ্রুতি দেন।

এফ আর টাওয়ারের ১৮ তলা অনুমোদন ছিল, উঠিয়েছে ২৫ তলা পর্যন্ত। এমন করেই অনুমোদনহীন, নিরাপত্তাহীন শত শত ভবন ঢাকার আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। কত সুরম্য ভবন। আমাদের দমকল বাহিনীর সদস্যদের বীরত্বগাথা নিয়ে মহাকাব্য হয়তো লেখা যাবে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে অবস্থা বড় নাজুক। আগুন লেগে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা বাড়ছে না সেই গতিতে, যে গতিতে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বাড়ছে।

মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। বিধির ফাঁক গলে একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটে। উচ্চমানের অগ্নি-নিরাপত্তা যেমন চাই, তেমনি মানুষের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন কর্তৃপক্ষসমূহের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। দশ বছর আগে নিমতলীর ঘটনার পর বলা হয়েছিল শিক্ষা হয়েছে। শিক্ষা গ্রহণ কি তবে এখনও চলছে?

আগুন কেন লাগে? বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটসহ নানা কারণেই আগুন লাগে। এই শহরের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মান থেকে যোজন যোজন দূরে। আন্তর্জাতিক মানের বিধি তৈরি হলেও যতক্ষণ প্রশাসন তা প্রয়োগ করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা না করবে, ততক্ষণ সব বিধিই অসার। পরিদর্শক দলের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেই আর নিয়ম মানার দায় থাকে না; এই অভিজ্ঞতা সর্বস্তরের। পরিদর্শন করার পর দোষ পায়নি, কিন্তু পরে আগুন লেগেছে এমন ঘটনা অসংখ্য।

ঢাকা উত্তরের মেয়র নতুন। তিনি বলেছেন তালিকা করবেন, কোনো ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন, তা যাচাই করবেন। আমাদের বোধোদয় হোক। শহরের সব বহুতলে, সব প্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ম যেন যথার্থভাবে প্রযুক্ত হয়, তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব। যারা নিয়ম মানবে না, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যবসার অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। প্রশ্নটি যখন জীবন-মৃত্যুর, তখন ন্যূনতম বিচ্যুতিও সহ্য করা চলে না।

ঢাকার দুজন মেয়র আছেন। কিন্তু আমরা মেয়রদের সীমাবদ্ধতা জানি। সরকারের বহু সংস্থা তাদের কথা শুনে না। তাই তাদের উদ্যোগ কোনো কাজে আসবে না। সিটি করপোরেশন হতে ফায়ার সার্ভিস, সবাই যেন সাযুজ্য বজায় রেখে শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্রিয় হয়, তা দেখার সময় এখন।

নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে। প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু আমরাও কেবল বিল্ডিং বানিয়েই যাবো, নিরাপত্তায় উদাসীন থাকব, তা হতে পারে না। বড় বড় কর্পোরেট হাউস, বড় বড় বাণিজ্য তাদের। এফ আর টাওয়ারসহ বড় উঁচু ভবনগুলোতে অফিস ভাড়া নেয়ার সময় তারা কেন অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা যাচাই করেন না? এটাওতো একটা চাপ ফেলতে পারে বড় ভবন মালিকদের উপর। আর কোনো প্রাণ যেন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার আগুনে দগ্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতেই হবে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন