ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

স্বাধীনতা অর্থবহ হবে কবে?

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ২৬ মার্চ ২০১৯

দৃশ্যপট ১৯৭১: ২৬ মার্চের ভোর। বিধ্বস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস। অসংখ্য মৃতদেহ। শাঁখারি বাজার, লক্ষ্মীবাজারে শবের স্তূপ। ধ্বংসপ্রাপ্ত ঢাকা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বুলেটে আর বেয়নেটে ক্ষত-বিক্ষত বাঙালির রক্তস্রোত। কারফিউ। পথে জলপাই রঙের ট্যাংক। পাকিস্তানি সেনাদের হিংস্র তাণ্ডব।

এরই মধ্যে ভোরের জবাকুসুম সংকাশ সূর্যের আলোয় চোখ মেলছে একটি নতুন দেশ, প্রসব বেদনায় কাতর বাংলামাতা। ছাব্বিশে মার্চ আমাদের পরম প্রিয় স্বাধীনতা দিবস। আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমির মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকাল। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাল। এর পর নয়মাসের গর্ভবাস, মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের শুভ আগমন।

পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে যে গণহত্যা, নারীধর্ষণ, ধ্বংসতাণ্ডবের শুরু ষোলই ডিসেম্বরে তার পরিসমাপ্তি। ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের ৯ মাস বাঙালির চরম যন্ত্রণার ও পরম গৌরবের কাল। এই নয়মাস আমরা যে একতা, বীরত্ব ও মহত্বের পরিচয় দিয়েছি গত ৪৮ বছরে তেমনটি আর দিতে পেরেছি কি?

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা দেখেছিলাম শ্মশান হয়ে যাওয়া সোনার বাংলা। আমরা বহন করছিলাম ত্রিশ লাখ শহীদের শব, তিনলাখ নির্যাতিত নারীর কান্না, আর অসংখ্য যুদ্ধশিশুর হাহাকার। পুরো দেশের অবকাঠামো ছিল বিধ্বস্ত, সম্পদ ছিল লুণ্ঠিত।

স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর পেরিয়ে ফিরে তাকানো যাক আজকের বাংলাদেশের দিকে। এ কথা ঠিক যে মার্কিন বিদ্বেষমূলক উক্তি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’কে মিথ্যা প্রমাণ করে আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি যে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে জানে। মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে পা রেখেছি আমরা।

জনগণের জীবন মান বেড়েছে নিঃসন্দেহে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় আমাদের অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিশীল। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও প্রতিবেশীদের তুলনায় ভালো। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও প্রতিবেশীদের জন্য উদাহরণ হিসেবে গণ্য হতে পারে।

নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতির দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বে ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে। ক্রিকেটে আমরা আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছি।

আমাদের অর্জন রয়েছে কিন্তু আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। এই অর্জন আমাদের সামর্থ্যের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এখনও কেন এদেশে ধর্ষিতার ক্রন্দন ধ্বনি শোনা যায়? কেন শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়? কেন এখনও সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে? এখনও কেন বেকারত্বের অভিশাপ তরুণসমাজের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে? কেন সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হয় না?

এসবের পিছনে রয়েছে দুর্নীতির ব্যাধি। দেশ থেকে দুর্নীতি আর রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যহারকে যতদিন দূর করা যাবে না ততোদিন এগুলো চলতেই থাকবে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যহার আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলার কারণে আমাদের দেশ আজও প্রার্থিত উন্নয়ন অর্জন করতে পারছে না।

স্বাধীনতা দিবসে আড়ম্বর আর একদিনের দেশপ্রেমিক সাজার ভণ্ডামী বাদ দিয়ে প্রয়োজন হলো দেশকে গড়ে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টা। দেশ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা আর নারী নির্যাতনের মতো দুটি দানবকে কেন আমরা এখনও দূর করতে পারছি না সে প্রশ্নের জবাব কে দিবে?

গত বছরে শিক্ষার্থী মৃত্যুর পর সারা দেশের শিশু কিশোর তরুণরা পথে নেমে এলো। তারপর আবার যে কে সেই। আবরারের মৃত্যুর পর কিছুদিন গেলে আবার সব আগের মতোই চলতে থাকবে।

আবার গাঁজাখোর বাসচালক আর ফিটনেসবিহীন পরিবহন অবাধে মানুষকে খুন করতে থাকবে। এগুলো যতদিন চলতে থাকবে ততোদিন ত্রিশ লাখ শহীদকে আমরা প্রকৃত মর্যাদা দিতে পেরেছি একথা বলার কোন অধিকার আমরা রাখি না। যতদিন তনুরা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হতে থাকবে, যতদিন তারা বিচার পাবে না ততোদিন একাত্তরের তিন লাখ নিপীড়িত নারীর দীর্ঘশ্বাস আমাদের অভিশাপ দিবে।

স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে প্রয়োজন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। প্রয়োজন দেশ থেকে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, ক্ষমতার দাপট দূর করা। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও সেটা পারিনি আমরা। যতদিন না পারছি ততোদিন স্বাধীনতা অর্থবহ হবে না। এ দায়িত্ব সরকারের একার নয়। স্বাধীনতার সুফল ভোগকারী প্রতিটি নাগরিকের।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন