এমপিওভুক্তির দাবি অযৌক্তিক হলে পরিষ্কার করে বলুন
২০ মার্চ থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন কয়েক হাজার শিক্ষক। রাস্তায় পলিথিন ও কাগজ বিছিয়ে শিক্ষকদের এভাবে অসহায়ের মতো শুয়েবসে থাকাটা কারো জন্যই মর্যাদাকর নয়।
এমপিওভুক্তির দাবিতে সারাদেশ থেকে এর আগেও শিক্ষকরা এভাবে ঢাকায় এসে ধরনা দিয়েছেন। কখনো শক্তি প্রয়োগ করে তাদের ঘরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কখনও আশ্বাস দিয়ে বুঝিয়েশুনিয়ে। শিক্ষকদের ওপর বলপ্রয়োগ যেমন নিন্দনীয়, তেমনি তাদের মিথ্যা আশ্বাস দেওয়াও সমর্থন করা যায় না। শিক্ষকতা একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা। শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার তাই কাম্য কিংবা প্রত্যাশিত নয়।
শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া কি অন্যায্য? তারা কি অযৌক্তিক দাবি তুলে বারবার সরকারকে বিব্রত করছে? কিন্তু আন্দোলন তো করছেন সরকারের স্বীকৃতি পাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। এদের অনেকেই দশ /পনেরো বছর ধরে বিনা বেতনে চাকরি করছেন। একজন মানুষ এই যে বছরের পর বছর ধরে বিনা বেতনে কাজ করছেন, ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান করছেন, তারা বেতন চাইলে সেটা অন্যায্য হবে কেন?
আমি একজন নন-এমপিও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে জানি তিনি ১৮ বছর ধরে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন। ২০০১ সালে তার স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত। ২০০৭ সাল থেকে ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, ভালোভাবে পাসও করছে। কিন্তু এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি। কেন?
স্কুলটিকে তো স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে তা দেখভালের দায়িত্ব কার? শিক্ষকদের বেতনভাতার নিয়মিত ব্যবস্থা না থাকলে তারা কি হাওয়া খেয়ে কিংবা পেটে পাথর বেঁধে পাঠদান করবেন? যদি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অপ্রয়োজনীয় কিংবা সংখ্যা অতিরিক্ত হয়ে থাকে তাহলে এগুলো স্বীকৃতি পেল কীভাবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে শিক্ষা বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট দফতরে পরিদর্শনের আবেদন করে, প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণের পরই পাঠদানের অনুমতি পাওয়া যায়। তারপর আরো শর্ত পূরণ সাপেক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি মেলে।
সরকার কি ধরে নেয় যে অন্য সব চাকরিতে বেতনভাতা দিতে হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের তা দিতে হবে না? যদি বলা হয়, সরকার কি কারো হাতেপায়ে ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য অনুরোধ করেছিলো? যারা অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে তাদেরই দায়িত্ব শিক্ষক-কর্মচারীদের মাইনেপাতি জোগানোর।
না, বছরের পর বছর পার করে এসে এমন কথা বলার অধিকার সরকার রাখে না। সরকারকে বিবেচনা করতে হবে যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো কি দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে, নাকি উপকারে আসছে? শিক্ষা বিস্তারে, শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে কি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো ইতিবাচক ভূমিকা নেই? এই প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ বাচক হয় তাহলে শিক্ষকদের বেতনবঞ্চিত রাখা যাবে না কোনোভাবেই। নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করতে হলে সরকারকে বাড়তি কতো টাকার ব্যবস্থা করতে হবে, সেটা কি হিসাব করে দেখা হয়েছে? এই টাকা জোগাড় করা কি খুব অসম্ভব? দুর্নীতি-অপচয়ের কতো গল্পই তো আমরা শুনি। এসব বন্ধ করেও তো শিক্ষার আলো ছড়াতে, মানব সম্পদ তৈরিতে টাকার ব্যবস্থা হতে পারে।
একজন নন-এমপিও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখাটি শেষ করতে চাই : ‘সরকার যদি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না-ই চায়, তবে দয়া করে যেন ‘নতুন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে না'- মর্মে গেজেট আকারে একটি ঘোষণা দেয়। এতেই আমাদের ভীষণ উপকার হবে। তখন আর মিছে আশায় অযথা এমপি, মন্ত্রীদের পিছে পিছে ঘুরে মরতে হবে না।
অনেক শিক্ষক-কর্মচারীই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের এই অনিশ্চিত জীবন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা, অন্যদিকে ম্যানেজিং কমিটি এবং অভিভাবকদের আঁকড়ে ধরে রাখার কারণে বের হয়েও আসতে পারছেন না।
স্থানীয় জনগণও অচিরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হবে – এই সান্ত্বনা দিয়ে থাকেন। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে বিনীত নিবেদন, একটা সিদ্ধান্তে আসুন। হয় অবিলম্বে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করুন, নইলে আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে না– মর্মে একটি ঘোষণা দিন'।
টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করলে বিষয়টি একটি গুরুতর মানবিক সংকটের জন্ম দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো সমস্যারই সমাধান হয় না। নন- এমপিওভুক্ত লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারীকে দুঃসহ এবং অসম্মানের জীবন থেকে মুক্তি দেওয়াটা সরকারের জনবান্ধব নীতির সঙ্গে কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক হবে না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস