ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সারা দেশের মানুষ জানে, শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১০:০৯ এএম, ২৩ মার্চ ২০১৯

সড়ক দুর্ঘটনায় ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের মেধাবী ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের আরো একটি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ২৮ তারিখ পর্যন্ত স্থগিত হয়েছে নানা আশ্বাসে। কিন্তু শিক্ষার্থীরাও জানে, সারা দেশের মানুষ জানে, শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না। আরো একটি এরকম আলোচিত মৃত্যু পর্যন্ত এই আলোচনা আর হবে না।

সড়কে শৃঙ্খলার কথা বলছে সবাই, কিন্তু সড়কে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার কোনদিন দেখেনি এদেশের মানুষ। সড়ককে যারা গণহত্যার ময়দান বানিয়েছে, তারা ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে নৈরাজ্যকে উৎসাহিত করেছে বারবার। রাষ্ট্র এবং ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থাকা শক্তিশালী মানুষগুলোও এদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে উল্টো ভিকটিমদেরই দোষারোপ করে যাচ্ছে।

সাধারণ মানুষ জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করে না, গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড় দেয়, ফুট ওভার ব্রিজ ব্যবহার করে না বলে যে চিৎকার করছি তার জন্যও রাষ্ট্র এবং ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থাকা নেতৃত্ব দায়ী। কারণ সামগ্রিকভাবে এটি সুশাসনের প্রশ্ন।

আবরার জেব্রা ক্রসিং দিয়েই পার হচ্ছিল। যে বাস চালক আবরারকে চাপা দিয়েছে, তিনি হয়তো জেব্রা ক্রসিং-এর অর্থই জানেন না। কারণ সারাদেশের পরিবহন শ্রমিকদের কাছে একটাই নির্দেশনা তাদের নেতা থেকে এসেছিল- “গরু ছাগল চিনলেই চলবে”।

'সুপ্রভাত' পরিবহনের যে বাসটি প্রগতি সরণির জেব্রা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবরারকে চাপা দিয়েছিল, তার চালকের যাত্রীবাহী বাস চালনার লাইসেন্স নেই, গাড়ির ফিটনেই নেই। ট্রাফিক সপ্তাহ যখন চলছে, তখন লাইসেন্স ছাড়া, ফিটনেস সনদ ছাড়া চালক এবং গাড়ি রাজপথে নামে কি করে? কারণ একটিই এ খাতে নৈরাজ্য করার জন্য মালিক-শ্রমিক এব ভয়ংকর ঐক্য বিরাজমান। তারা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে জানে যে, তাদের কিছু হবেনা।

গত বছরের জুলাইয়ে বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ফুটপাতে দাঁড়ানো দু'জন শিক্ষার্থীকে হত্যা এবং আরও কয়েকজনকে আহত করেছিল জাবালে নূর কোম্পানির যে বাসটি, তার চালকেরও লাইসেন্স ছিল না। ওই ঘটনার প্রতিবাদে নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা স্কুল ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের সব প্রান্তে।

অনেক স্থানে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা গাড়ির ফিটনেস, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করে। দেশবাসী অবাক হয়ে দেখল- সর্বত্র সীমাহীন নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা। গত মঙ্গলবার প্রগতি সরণিতে দুর্ঘটনার পর বোঝা গেল সরকারে উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে মধ্য পর্যায় পর্যন্ত নীতি নির্ধারকরা প্রতিশ্রতি শুধু দেয়ার জন্যই দিয়েছিলেন, বাস্তবায়নের জন্য নয়।

একথা সত্য যে, শুধু চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও যানবাহনের ফিটনেস থাকলেই পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। পথচারী থেকে শুরু করে সবার দায়িত্ব আছে এ বিষয়ে। মানুষকে সচেতন হতে হবে। ট্রাফিক নিয়ম মানতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সততার সাথে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সড়ক মহাসড়কে পরিবহন থেকে চাঁদা তুলে আর যাই হোক তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাবেনা।

পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের একটি অংশের মধ্যে মানুষকে জিম্মি করে রাখার যে প্রবণতা, তার অবসান ঘটাতে হবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। লাইসেন্স ও ফিটনেস প্রদানে দুর্নীতি, সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে দুর্নীতি, রাস্তায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি, পরিবহন খাতে বিশাল চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারলে আমাদের শুধু সড়কে খুনের শিকার হওয়া একেকজন মানুষের নামে আন্ডারপাস বা ওভারপাস করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

গত বছর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে আগে, সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে একদিনে দুটি আইন পাস হয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং সড়ক পরিবহন আইন। কারো কোন আপত্তি আমলে না নিয়ে অতি দ্রুততার সাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়। আর পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় মানুষের মুখে পোড়া মবিল মেখে দিয়ে সংসদে পাস হওয়া বহুল আলোচিত 'সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮'-কে লাপাত্তা করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ নিয়ে সরকারের কোন স্তরে এখন কোন কথা নেই। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে কি করে সম্ভব সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো?

সড়ক দুর্ঘটনায় কোন লাগাম নেই। ট্রাফিক সপ্তাহ হয়, গালভরা নানা বুলি আওড়ানো হয়, সরকার নানা আশ্বাস দেয়, কিন্তু দুর্ঘটনা এবং তার জেরে প্রাণহানি এড়ানো যাচ্ছে না। গত ২০ মার্চ যেদিন আন্দোলন চলছিল, সেদিনও সারাদেশে ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে সড়কে।

সড়কে যাদের প্রাণ যায়, যারা পঙ্গু হয় তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র মানুষ। তাই এ নিয়ে উচ্চস্তরে ভাবনা কম। একটা দুটো ঘটনা আলোচনায় এলে যান নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি আসে, আইন মেনে চলার জন্য কড়া নজরদারির আশ্বাস দেয়া হয়। তারপর আবার সব শিথিল হয়ে যায়।

স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ শুরু না করলে সড়কে গণহত্যা বন্ধ করা যাবেনা। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হলে টার্গেট ট্রিপের ভয়ংকর থাবা থেকে পরিবহন শ্রমিকদের রেহাই দিতে হব। এটা পারা গেলে তারা মানুষ মারবে কম, কারণ তখন রেষারেষি ও দাপাদাপি কমবে।

১৫০টি বাস কোম্পানিকে একটা সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক যে ফ্রেন্চাইজ প্রথার কথা বলছিলেন তার দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। বিশেষত যে রেষারেষির কারণে প্রায় নিয়মিত প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে, সেই টার্গেট ট্রিপ প্রথা আজই বন্ধ হোক। যাত্রী তুলবার জন্য বাসগুলোর রেষারেষি-অধিক যাত্রী, অর্থাৎ অধিক কমিশন। সেই বাড়তি কমিশনের লোভে ভয়ানক বাস চালকরা প্রতিযোগিতায় নামে। এবং পরিণামে বিপজ্জনক ভাবে ওভারটেক, সিগন্যাল অমান্য-সহ পথ-আইন ভাঙবার প্রবণতা বাড়ে।

কোন রুটে কত বাস দরকার, তার হিসেব করুন মাননীয়রা। পরিকল্পনা করুন আন্তরিকতার সাথে। শহর জুড়ে ফ্লাইওভারের বাড়বাড়ন্ত, উন্নততর সিগন্যাল ব্যবস্থা, ঘটা করে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন— কোন কিছুই সড়কে মৃত্যুর যথেষ্ট রাশ টানতে পারবে না। মাননীয়রা ডিজিটাল সিস্টেম আনুন, সিগনাল না মানলেই, ওভার স্পীড হলেই রাডারে ধরা পড়বে, এমন ব্যবস্থা করুন। নিরাপদ সড়ক শুধু আশ্বাসের বিষয় নয়, অন্তর দিয়ে মানুষকে বোঝার বিষয়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন