ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাদেশের নতুন সিএমএলএ নুরুল হক নুর

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ১২:৫৬ পিএম, ১৮ মার্চ ২০১৯

বাংলাদেশে এই মুহুর্তে সবচেয়ে আলোচিত রাজনীতিবিদের নাম নুরুল হক নুর। তাকে ছাত্রনেতা বললেই ভালো হতো। কিন্তু তিনি মাত্র এক সপ্তাহে রাজনীতিতে এমন উথাল-পাথাল ঢেউ তুলেছেন যে নিছক ছাত্র রাজনীতির গন্ডিতে তাকে আটকে রাখা মুশকিল।

প্রায় ২৯ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েই দারুণ চমক দেখান নুরুল হক নুর। প্রচলিত কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তার সংগঠনের একটি পোশাকি নাম আছে বটে- সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, কিন্তু নুরুল হক নুর আসলে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতা। এখনো গায়ে পটুয়াখালীর গন্ধ, চলনে-বলনে স্মার্ট নন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে একটি আপাত সফল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে উঠে আসেন নুর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই কোটার পক্ষে অবস্থান নিলেও আন্দোলনের পর অনেকটা অভিমান করে কোটা বাতিল করে দেন। কোটা আন্দোলনের সেই সাফল্যই নুরুল হক নুরকে তুলে আনে ডাকসুর নেতৃত্বে। আগে থেকেই আলোচনা ছিল অন্তত ভিপি পদে নুর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন। নির্বাচনের দিন দুপুরে রোকেয়া হলে এক নাটকীয় ঘটনায় আবারো আলোচনায় আসেন তিনি। রোকেয়া হলে অনিয়মের খবর পেয়ে ছুটে যান তিনি। সেখানে ছাত্রলীগের নারী কর্মীদের সাথে তার কথাকাটাকাটি হয়। হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে নারীদের হামলায় নুর অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

নারীরা মেরেছে, এমন খবরে বাড়তি সহানুভূতি পান তিনি। তবে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে কেউ তার ওপর হামলা করেনি, তিনি এমনিতেই পড়ে গেছেন। অনেকে তার এই অজ্ঞান হয়ে যাওয়াকে নাটক বলেছেন। তবে আমার কাছে নাটক মনে হয়নি। তিনি আসলে পানিশূন্যতায় ভুগছিলেন। নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ততায় হয়তো তার প্রয়োজন মতো পানি খাওয়া হয়নি। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক; এই অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটা তার জন্য অনেক কাজে লেগেছে। সহানুভূতি ভোট তো পেয়েছেনই, আবার নুরের ওপর কথিত হামলার পরই আসে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা।

ডাকসুর ভিপি পদে নির্বাচিত হয়ে পরদিন ক্যাম্পাসে আসেন নুরুল হক নুর। তখন থেকে শুরু হয় তার আসল খেলা। তিনি সকাল বিকাল সিদ্ধান্ত বদলাতে থাকেন। একবার বলেন, তাদের জেতা দুটি পদ ছাড়া বাকি পদগুলোতে নির্বাচন চান; আবার বলেন, পুরো ডাকসুতেই পুনর্নির্বাচন চান। পুনর্নির্বাচনের দাবির আন্দোলনে গিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেন। আবার বলেন, শিক্ষার্থীরা চাইলে তিনি দায়িত্ব নেবেন। শোভন জড়িয়ে ধরলে তিনি আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। আবার লিটন নন্দীরা এলে কঠোর অবস্থানে চলে যান।

নুরুল হককে আমি ভালো চিনি না। একপক্ষ তাকে শিবির প্রমাণে ব্যস্ত। আরেকপক্ষের দাবি, তিনি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। তবে আগেও বলেছি, শিবির না করলেও যে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে তিনি উঠে এসেছেন, সেটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী স্বার্থপর আন্দোলন। নির্বাচনের পর নুরুল হকের কথাবার্তা আর কার্যকলাপ দেখে একবার মনে হয় তিনি অতি চালাক, শোভন-লিটন নন্দী সবার সাথেই থাকতে চান।

আবার মনে হয় তিনি অতি সরল। তিনি সবার কথাই শোনেন। কিন্তু ডাকসুর ভিপির একটা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব থাকা উচিত। তিনি সবার কথা শুনবেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবেন নিজের মতো। সামনে উপস্থিত কারো কথায় যদি প্রভাবিত হন, তাহলে আর তিনি ডাকসুর ভিপি কেন?

হয় তাকে স্পষ্ট করে বলতে হবে, আমি পুনর্নির্বাচন চাই। এছাড়া আমি দায়িত্ব নেবো না। নইলে বলতে হবে, যা হওয়ার হয়েছে। এখন ডাকসুতে গিয়ে আন্দোলন করতে হবে। দোদুল্যমানতা আরো বেশি বিভ্রান্তিকর। এর আগে আমি লিখেছিলাম, 'এতই যদি দ্বিধা, তবে জন্মেছিলে কেন?' এখন বলতে হচ্ছে, ভাই নুরুল হক, আপনি যে কোনো একটা সিদ্ধান্ত নেন। কথায় বলে, রঙ ডিসিসান ইজ বেটার দ্যান ইনডিসিসান।

আসলে পুনর্নির্বাচনের আন্দোলনটা নুরুল হকের নয়, এটা লিটন নন্দীদের। ডাকসুর ভিপি হিসেবে নুর সে আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন মাত্র। ভিপি হয়ে যাওয়ার পর নুরের আসলে পুনর্নির্বাচনের আন্দোলন করার দরকার নেই। তিনি আসলে চক্ষুলজ্জার কারণে এ আন্দোলনের পাশে আছেন। কিন্তু লিটন নন্দীদের আন্দোলন ছাড়া উপায় নেই।

এতদিন ক্যাম্পাসে বামদের যে বিশাল ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, নির্বাচনের পর তা হাজারের ঘরে এসে ঠেকেছে। তাদের এখন নিজেদের মুখ বাঁচাতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। সে আন্দোলনে ডাকসুর ভিপির সমর্থন খুব দরকার। তাই নুরকে নিয়ে সবার এত টানাটানি।

পুনর্নির্বাচনের আন্দোলনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও পরাজিত ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। নির্বাচনের পরদিন নুরুল হককে জড়িয়ে ধরে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। তাতেই সব উত্তেজনা শেষ। তারপরও বামরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বটে, তবে সে আন্দোলন আর হালে পানি পাচ্ছে না।

পুনর্নির্বাচনের আন্দোলনে পানি ঢেলে দিয়েছেন নুরুল হক নিজেই। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গত শনিবার ডাকসুর অন্য নেতাদের সাথে নুরও গণভবনে গিয়েছিলেন। নুর অবশ্য সবার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাননি, গেছেন আলাদা গাড়িতে। তবে গণভবনের বক্তৃতায় একবারও পুনর্নির্বাচনের দাবি না তোলায় আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়েন তিনি।

আন্দোলনের মাথার এমন পচনে ক্ষুব্ধ লিটন নন্দী। তার আসল ক্ষোভ আন্দোলনের সম্ভাবনাটা ফুরিয়ে যাওয়ায়। গণভবনে পুনর্নির্বাচনের কথা বলায় নুরের যুক্তিটা আমার পছন্দ হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। তার আমন্ত্রণে সাড়া দেয়াটা সৌজন্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। পুনর্নির্বাচনের দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে করবো, প্রধানমন্ত্রীর কাছে কেন। খুবই ভালো যুক্তি সন্দেহ নেই। কিন্তু পুনর্নির্বাচনের কথা না বললেও নুর গণভবনে বলেছেন, 'এই নির্বাচনে অনিয়ম ত্রুটি চোখে পড়েছে। সামনের নির্বাচনে যেন অনিয়ম ত্রুটি চোখে না পড়ে। ১০০ ভাগ পিউরিটি সব কাজে পাওয়া যায় না। কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকবেই। সেটা ধরে নিয়েই আমরা আগাই।'

তার মানে তিনি বলেছেন এবারের ডাকসু নির্বাচন মেনে নিয়ে আগামী নির্বাচনে যেন ত্রুটি-বিচ্যুতি না হয়। কিন্তু গণভবন থেকে বেরিয়ে পরদিনই ক্যাস্পাসে ফিরে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আবার সংহতি প্রকাশ করেন নুর। এখন কোনটা আসল নুর, বলা মুশকিল। আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর অবয়বে মায়ের ছবি দেখে তাকে পা ছুঁয়ে সালাম করা আর পরদিন পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করা ব্যক্তি কি একই? পাশাপাশি দুটি ছবি বড্ড বেমানান লাগে।

এখন সবাই নুরুল হককে তুলনা করছেন এরশাদের সাথে। সকাল বিকাল সিদ্ধান্ত এরশাদ চিরকালীন সিএমএলএ- ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট। নুরুল হক নুর এখন বাংলাদেশের নতুন সিএমএলএ। এমনকি ফেসবুকের আলোচিত চরিত্র সেফুদাও ঘণ্টায় ঘণ্টায় নুরের সিদ্ধান্ত বদলে বিরক্ত। তিনিও নাকি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না।

নুরুল হকের দোদুল্যমানতাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। দায়িত্ব নিলে তিনি বামদের সমর্থন হারাবেন। বামরা তাকে বিশ্বাসঘাতক বলবে। তবে আমার ধারণা কয়েকশ লোকের আন্দোলনের কারণে তিনি ডাকসুর ভিপির দায়িত্ব নেয়া থেকে বিরত থাকবেন না। সবাইকে নিয়ে নতুন কৌশল নেয়ার চেষ্টা করবেন। নইলে বিএনপির মতো 'আন্দোলনের অংশ হিসেবে'ই দায়িত্ব নেবেন তিনি। দেখা যাক আর কতবার পল্টি মারতে পারেন বাংলাদেশের নতুন সিএমএলএ নুরুল হক নুর।

probhash-amin

এইচআর/এমকেএইচ

আরও পড়ুন