রাজার মৃত্যুর দায় তার একার নয়, গোটা সাংবাদিক সমাজের, আমাদেরও!
‘কেস টু ফিট’, আমরা এক সময় যারা যুগান্তরে কর্মরত ছিলাম, বিশেষ করে তার (শফিউল আলম রাজা) সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল, তারা শফিউল আলম রাজার মুখে এ বাক্যটি প্রায় সময় শুনতাম।
একাধারে সাংবাদিকতা ও ভাওয়াইয়া গানের অন্তঃপ্রাণ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রাজা সম্ভবত ২০০০ সালের দিকে রাজধানীর থানাগুলোর ওপর সরেজমিন প্রতিবেদন লিখে ডিআরইউ ও টিআইবির শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানী রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড পেয়ে হইচই ফেলে দেন। সেই যে সাফল্যের যাত্রা শুরু তারপর সাংবাদিকতা ও গানে আরও অনেক পুরস্কার জুটেছিল তার ভাগ্যে। যদি ভুল না হয় এক সময়ের তুখোড় সাংবাদিক রাজা কয়েক বছর আগে ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করতে গিয়ে বেশ কিছুদিন অফিসে অনুপস্থিত থাকায় যুগান্তরের চাকরিটা হারান। চাকরিটা হারালেও পাওনা টাকা বুঝে পাননি তিনি।
এরপর আর থিতু হয়ে চাকরিটা করা হয়নি। সর্বশেষ প্রিয়ডটকমে প্রধান প্রতিবেদকের চাকরি ছেড়ে দেয়ার (বাধ্য হয়েছিলেন) আগে ও পরে চাকরি দরকার বলে জানিয়েছিলেন। আমার মতো পরিচিত আরও অনেকের কাছে হয়তো চাকরি চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি ও আমরা তার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে পারিনি।
পেশায় সৎ থেকে নিয়মিত বেতন পেয়েও যেখানে সাংবাদিকতা করা এখন দিনকে দিন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে যোগ্যতা থাকার পরও কম বেতনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য ধরনা দেয়া ও মাসের পর মাস বেকার হয়ে বসে থাকার ফলে তীব্র মানসিক কষ্টে হৃদঘড়ি আর কাজ করতে চায় না। আমি নিশ্চিত শফিউল আলম রাজার ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছে।
দু’নম্বরি করলে রাজা বাড়ি গাড়ি করতে পারতেন, কিন্তু গানপাগল এ মানুষটি সেদিকে পা বাড়াননি। শিল্পী সত্তাই তাকে ওমুখ হতে দেয়নি। দেশের গন্ডি পেরিয়ে সুদূর অস্ট্রেলিয়াসহ একাধিক দেশে দেশের ভাওয়াইয়া গান পৌঁছে দিয়েছেন। সর্বত্র হাত তালি আর বাহবা পেলেও অধিকাংশ মাস শেষ না হতেই পকেট গড়ের মাঠ থাকতো এ গুণী শিল্পীর।
বেকার হওয়ার পর বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ডাকে মাসে কয়েক দিন হয়তো গান গেয়ে সম্মানী বাবদ কিছু টাকা রোজগার করতেন কিন্তু তা দিয়ে সংসার চলতো না। বেকার থেকে সংসার চালানো যে কতটা কষ্টকর তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। মাস শেষ হতেই বাড়িভাড়া, নিত্যদিনের বাজার খরচ, সন্তানদের স্কুল ও শিক্ষকের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ। সৎ সাংবাদিক হাসি মুখের রাজার হৃদয়ে এসব নিয়ে নীরব রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। যার চূড়ান্ত ফল হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু!
তাই বলি, রাজার মৃত্যুর দায় শুধু রাজার একার নয়, আমরা যারা (কথিত সাংবাদিক নেতা, সহকর্মী, বন্ধু) খুব আফসোস করছি; আহারে, উনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন, এ মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না- এ জাতীয় কথা বলছি, তারা এবং আমি, আমরা কেউ এড়াতে পারি না। রাজার মৃত্যুর জন্য রাজা একা দায়ী নয়, দায়ী গোটা সাংবাদিক সমাজ। এর পরের সিরিয়ালে হয়তো আপনি, আমিও থাকতে পারি।
রাজার মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই আলোকিত বাংলাদেশ থেকে চাকরিচ্যুত হওয়ার দিন কয়েক পরই প্রবীণ সাংবাদিক সিদ্দিকুর রহমান মারা যান। পাওনা টাকা আদায়ের জন্য তিনি হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা তার পাওনা টাকা আদায়ের চেষ্টা করলেও মৃত্যুর আগে তা আদায় করে পারেননি।
একসময় সাংবাদিক পেশা সম্মানের হলেও নানা কারণে সৎ সাংবাদিকরা কোণঠাসা। ২০ বছর চাকরি করেও কেউ হয়তো মাথা গোঁজার একটু টুকরো জমি, ফ্ল্যাট, ব্যাংক-ব্যালান্স তো দূরের কথা দুবেলা খেয়ে কোনোভাবে জীবন ধারণ করতে পারছেন না। আবার কিছু কথিত সাংবাদিক দু’কলম না লিখেও দু’চার বছরেই ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি, ব্যাংক-ব্যালান্সের মালিক হচ্ছেন।
যারা সততার সাথে সাংবাদিকতা করেন তারা সাংবাদিক কল্যাণ ফান্ড থেকে সাহায্যের আবেদন করতেও লজ্জাবোধ করেন। তাই না খেয়ে থেকেও হাসিমুখে সমাজে চলাফেলা করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের মানসিক অবস্থা খারাপ হয়; হৃদপিণ্ড, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হন।
কয়েক দিন আগেই ‘বিশ্ব কিডনি দিবস’ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে একজন খ্যাতনামা ইউরোলজিস্ট বলছিলেন, কয়েক বছর আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখতে পান সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই কিডনির অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন, কিন্তু তারা জানেনই না।
গত কয়েক বছরে বেশকিছু সংবাদপত্র বন্ধ ঘোষণার ফলে অসংখ সাংবাদিক বেকার হয়েছেন। দিনের পর দিন বেকার, সংসারের খরচ জোগানোর চিন্তাভাবনা, স্ত্রী ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় তারা নীরবে কঠিন অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, রাজধানীসহ সারাদেশে একটি জরিপ চালালে বিভিন্ন পেশার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কঠিন অসুখ ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সাংবাদিকতা পেশার লোকজনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রাজার কথা বলতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই সাংবাদিকতা পেশার অনিশ্চিয়তার কিছু তথ্য সন্নিবেশিত হলো।
বন্ধু ও সহকর্মী রাজা ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে এ মুহূর্তে স্মৃতিপটে কত কথা ভেসে উঠছে (যুগান্তরের রমরমা সময়ে ক্রাইম টিমে ফকরুল আলম কাঞ্চন, পিনাকি দাস গুপ্ত, মিজান মালিক, তৌহিদুর রহমান, শফিউল আলম রাজা)। বিশেষ করে তৌহিদ, পিনাকিদা, মরহুম জাকির ভাই, রাজা ও আমার কতদিন মফিজের দোকানের পরোটা, নয়া দিগন্তের নিচে মানিকের চায়ের দোকানে গল্পগুজবে কেটেছে। এখন সবই অতীত। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী বন্ধু রাজা ভাই।
এমইউ/আরএস/জেআইএম