সংখ্যালঘু সমস্যা: পাকিস্তানি ভূত ঘাড় থেকে নামবে কি!
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক আয়োজিত ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে বলেছেন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এখন ‘কেবল সময়ের ব্যাপার’।
তিনি আরো বলেছেন, আগামী এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ‘বৈষম্যবিরোধী আইন উপস্থাপনের লক্ষ্যে’ আইন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আদালতে বিচারাধীন সংখ্যালঘুদের মামলাগুলো যাতে ‘দ্রুত নিষ্পত্তি হয় সে জন্য প্রসিকিউশনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ নিতে বলবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মন্ত্রীর এই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে আলোর রেখা যেন আরো স্পষ্ট হলো।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিগত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার পরই এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এবার যদি আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়, তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভবপর হবে। কেননা প্রথমত নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যান্য অধিকার সুরক্ষার সঙ্গে আইন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বলা হয়েছে যে, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে। সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব প্রকার আইন ও অন্যান্য অন্যায় ব্যবস্থার অবসান করা হবে।
স্বাভাবিকভাবেই এখন নির্বাচনের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের উল্লিখিত বক্তব্য থেকে সরকারিভাবে বাস্তবতার স্বীকৃতি ও সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। স্বীকৃতিটা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ধারাবাহিকভাবে ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও সংখ্যালঘুদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয় না। আর এতদসংক্রান্ত সমাধানটা হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের মামলাগুলো যাতে ‘দ্রুত নিষ্পত্তি হয় সে জন্য প্রসিকিউশনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ নিতে বলা হবে। ধরেই নেয়া যায়, কমিশন গঠন ও আইন প্রণয়ন ইত্যাদি করতে কিছু সময় লাগবে। কিন্তু প্রসিকিউশনকে মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে নির্দেশ দিতে সময় লাগার কথা নয়। নির্বাচনী ওয়াদা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই নির্দেশ প্রদান জরুরি। প্রসঙ্গত, মন্ত্রী বলেছেন, পঁচাত্তরের পর সুদীর্ঘ ২১ বছর তারা বিচার পাওয়ার জন্য বিচার বিভাগের কাছেও যেতে পারেনি। এদিকে বাস্তবতা হচ্ছে, এখন যেতে পারলেও মামলা দিনের পর দিন ঝুলে থাকছে।
একটা প্রবাদ রয়েছে, জাস্টিস ডিলেড ইজ জাস্টিস ডিনাইড। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর ‘সকল ধর্মের সমান অধিকার এবং দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-জাতিগোষ্ঠী, উপজাতি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার ফলে বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান এবং তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার’ কথা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই কখন কীভাবে তিনি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন, কতটুকু তা কার্যকর হয় এবং কমিশন গঠন, সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বৈষম্যমূলক আইন কতটা দ্রুত গৃহীত হয়; তা দেখার জন্য দেশবাসী বিশেষত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষ আগামী দিনগুলোতে অপেক্ষা করে থাকবে।
বলাই বাহুল্য, নানা ধরনের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বর্তমান দিনগুলোতে থাকলেও পাঁচ বছর আগের মতো বিশেষভাবে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে যুদ্ধংদেহী তাণ্ডবের অবস্থা দেশে এখন নেই। পত্রপত্রিকা পাঠ ও তৃণমূল থেকে প্রাপ্ত খবরে অনুমান করা যাচ্ছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন আক্রমণ প্রভৃতি বিক্ষিপ্ত ঘটনাও এখন অপেক্ষাকৃত অনেক কম। এবারের নির্বাচনের আগে পরে দেশের ইতিহাসে প্রথম প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ইস্যু হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দাবি যেমন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে লক্ষ্য ও পরিকল্পনা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
পাঁচ বছর আগে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুরা যেন দেশত্যাগে বাধ্য না হয়, সে জন্য ‘জাতীয় কমিশন’ গঠন এবং ‘বিশেষ আইন প্রণয়নের’ দাবি তুলে ধরা হয়েছিল। এবারে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তা পরিবর্তিত হয়ে ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং বৈষম্যমূলক আইন বাতিল করার দাবি উঠে এসেছে।
উল্লেখ্য, গত নির্বাচনের আগেও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি ছিল, এবারো তেমনি রয়েছে। এদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বিষয়ে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বিগত ২০১৪ সালের ইশতেহারে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, বৈষম্যমূলক আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করার কথা ছিল না। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ যে সব দাবি নির্বাচনের আগে তুলে ধরেছিল, তার মধ্যে একমাত্র মন্ত্রণায়লয় গঠনের দাবি ছাড়া সব দাবিই আওয়ামী লীগের ইশতেহারে তুলে ধরা হয়েছে।
এবারে বাস্তব পরিস্থিতি তথা নির্যাতন ও আক্রমণ নিয়ে হতাশা ও অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ার এখন পর্যন্ত কারণ নেই। আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উল্লিখিত সংখ্যালঘু কমিশন ও বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করার প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলায় হতাশা ও আস্থাহীনতা সৃষ্টির কোনো অবস্থা থাকছে না। এখন প্রয়োজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের আস্থা ও বিশ্বাস রেখে যথাযথ ভূমিকা রাখা। ইশতেহারে এ বিষয়ে যা ওয়াদা করা হয়েছে, তা বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য যথাযোগ্য ভূমিকা রাখা। সংখ্যালঘু কমিশন গঠন আমাদের দেশে একেবারেই নতুন ধারণা। কমিশনের গঠনবিন্যাস ও ক্ষমতা, সংখ্যালঘুর সংজ্ঞা, আইন প্রণয়ন, আইনের আওতা, কাজের পরিধি, বাস্তবায়নের পন্থা প্রভৃতি যথাযথভাবে ঠিক করে এবং কার্যকর রেখে যদি অগ্রসর হওয়া যায়, তবেই কেবল এ ক্ষেত্রে দায়মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রয়েছে ন্যাশনাল কমিশন ফর মাইনরিটিজ। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে এটি গঠিত হয়। সেখানে রয়েছে ২৭ বছরের অভিজ্ঞতা। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে সরকার যদি সংখ্যালঘু ও সুশীল সমাজের নেতাদের সহযোগিতা নিয়ে দ্রুত কমিশন গঠন ও তাকে কার্যকর করতে পারে, তবে অন্ধকারে আলোর রেখা ফুটতে পারে। ইতোমধ্যে উল্লিখিত ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভায় আইনমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক একটি মতামত তুলে ধরেছেন। এটা হাতে এলেও তা এখনো পড়তে পারিনি। নিঃসন্দেহে নাগরিক সমাজের এটা ভালো উদ্যোগ।
প্রসঙ্গত, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে তিন বছরের মাথায় সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার মৃত্যুর পর কার্যত পাকিস্তানি ধারায় দেশ ফিরে গেলে এমন একটা মিথ দাঁড়িয়েছিল যে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের নাগরিকদের সমমর্যাদা ও অধিকার সুনিশ্চিত হবে।
অভিজ্ঞতা থেকে বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৯৬-২০০১ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের শাসনামলে এ ক্ষেত্রেও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের পর সবটাই বিপরীতমুখী ও ভয়াবহ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আবারো আওয়ামী লীগ সরকার ফিরে আসার পর সংখ্যালঘুরা ভাবতে থাকে ঐতিহ্য অনুযায়ী দলটি সমমর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষিত করবে। কিন্তু ২০১৪ সালে রানা দাশগুপ্তের লেখা থেকেই বুঝা যাবে, তখন সংখ্যালঘুদের অবস্থা এবং তাদের মনোভাব কেমন ছিল। এবারে এই অবস্থা পরিবর্তনের সুযোগ সমুপস্থিত। এই সুযোগকেই আজ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাজে লাগানো ভিন্ন বিকল্প নেই।
আদৌ কি এমনটা ভাবা যায়, হাইকোর্টের নির্দেশনায় গঠিত সাহাবুদ্দিন কমিশন যে হাজার পাঁচেক মামলার তদন্ত করেছিল, সেই তদন্ত রিপোর্ট ২০১২ সালে পেশ করা হলেও এখন পর্যন্ত কমিশনের সেই তেমনভাবে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। আরো দুর্ভাগ্যজনক ও ক্ষোভের বিষয় এই যে, পাকিস্তানি আমলের শত্রু সম্পত্তি আইন ভিন্ন নাম নিয়ে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে এখনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা জাতির ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে আছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অর্পিত সম্পত্তি বিষয়ে যথাযথ অঙ্গীকার ছিল। ২০১৪ সালের ইশতেহারে এ বিষয়ে কিছুই ছিল না। কেননা ভাবা হয়েছিল পাকিস্তানি ওই ভূত ঘাড় থেকে নামানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ভূত যে এখনো ঘাড়ে রয়ে গেছে এর প্রমাণ হচ্ছে, এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে বলতে হয়েছে, ‘অর্পিত সম্পত্তি সংশোধনী আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।’
অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানি ভূত-পেত্নী জাতির ঘাড় থেকে নামানো খুব একটা সহজ সরল কাজ নয়। প্রকৃত বিচারে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ভূত জাতি হিসেবে আমরা ঘাড় থেকে নামাতে পারব কি পারব না, এটাই আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশবাসী ৪৮তম মহান স্বাধীনতা দিবস পালনের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কামনা করছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় বিদ্যমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় ভারসাম্য বজায় রেখে লাখ লাখ শহীদের রক্তরঞ্জিত জন্মলগ্নের অসাম্প্রায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ধারণ করে ইপ্সিত লক্ষ্যানুযায়ী দেশ অগ্রসর হোক।
লেখক : রাজনীতিক।
এইচআর/জেআইএম