সবার জন্য সুস্থ কিডনী অর্জনে করণীয়
কিডনী রোগের প্রাদুর্ভাব আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। সমগ্র বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশেও এখন কিডনী রোগ পরিস্থিতি ভয়াবহ। অত্যন্ত জনবহুল এবং দরিদ্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে এদেশের কিডনী বিকল রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ খুবই সীমিত।
বিশ্বব্যাপী কিডনী রোগীদের নিয়ে চিন্তার ধরন আজ বদলে গেছে। এখন কিডনী বিকল রোগীদের চিকিৎসার চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে কিডনী বিকল প্রতিরোধ করা। এর যুক্তিযুক্ত কারণও আছে। এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কিডনী রোগীদের চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে ৪৮ বিলিয়ন ডলার যা আমাদের জাতীয় বাজেটের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শুধু কিডনী বিকল চিকিৎসায় যে অর্থ ব্যয় হয় তা যুক্তভাবে ফুসফুসের ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার ও ত্বকের ক্যান্সার চিকিৎসার চেয়েও অনেক বেশি। এতে সহজেই বুঝা যায় যে, কিডনী বিকল কতটা ভয়াবহ।
কিডনী বিকলের ফলে যে শুধু একটা মানুষের অকাল মৃত্যু হয় তা নয়। বরঞ্চ পুরো পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। তাই এই ভয়াবহ রোগ প্রতিরোধের জন্য এখন বিশ্ব তৎপর।
আসুন তাহলে আমরা সংক্ষেপে জেনে নেই কিভাবে আমরা ভয়াবহ কিডনী বিকল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি এবং আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনীকে সুস্থ রাখতে পারি। এখানে একটি অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য জানিয়ে রাখি যে, বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত দেশগুলোতে যেখানে সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান মিলে শতকরা ৫ ভাগ কিডনী বিকল রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে একটু সচেতন হলে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনী বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য অনেক টাকার দরকার হয় না, প্রয়োজন শুধু আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন ও তা নিয়মিত চর্চা করা। বিশ্বব্যাপী গৃহীত সেই স্বর্ণালি উপায় নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করছি-
এই আটটি পদ্ধতি হল-
১. কায়িক পরিশ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করা
২. উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা
৩. সুপ্ত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা
৪. স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
৫. পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা
৬. ধূমপান থেকে বিরত থাকা
৭. ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধ সেবন না করা এবং
৮. নিয়মিত কিডনীর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা
এ পর্যায়ে আমি বিনয়ের সাথে উল্লেখ করতে চাচ্ছি যে, কিডনী এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্যাম্পস যে লক্ষ ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিল আজ তা অনেকটাই সফল।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশব্যাপী প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি ক্যাম্পস এ যাবৎ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প এর মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করেছে ৬৭০০০ এরও অধিক রোগীকে। চিকিৎসার পাশাপাশি ছিল প্রাথমিক অবস্থায় কিডনী রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা ছাড়াও বিশ্ব কিডনী দিবস উপলক্ষে স্ক্রিনিং, গোলটেবিল বৈঠক ও শোভাযাত্রা নিয়মিত ভাবে আয়োজন করে আসছে। প্রায় ৩০০ এর অধিক টেলিভিশন টকশোতে অংশগ্রহণ করে দেশব্যাপী কিডনী রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তারই পথিকৃৎ এর ভূমিকায় রয়েছে ক্যাম্পস।
প্রান্তিক অঞ্চলের রোগীদের চিকিৎসার জন্য টাংগাইল ও চাঁদপুরে চালু করা হয়েছে ডায়ালাইসিস সেবা কেন্দ্র। যেখানে নিরলস ভাবে সেবা প্রদান করা হচ্ছে কিডনী বিকল রোগীদের। ডায়ালাইসিস সেবা আরো সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পস। এর পরিসর বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সচেতন হয়েছে এবং যার ফলে তারা সম্ভাব্য কিডনী রোগ থেকে রক্ষা পেয়েছে।
এবারে সমসাময়িক সময়ে কিডনী রোগ প্রতিরোধে যে ৮টি স্বর্ণালি সোপানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে খানিকটা আলোকপাত করি ।
১. কায়িক পরিশ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করা
কায়িক পরিশ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম কিডনী রোগ প্রতিরোধ করে। পাশাপাশি ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনে, কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধ করে এবং রক্তনালী সচল রাখে। সমীক্ষায় দেখা গেছে শুধু নিয়মিত হাঁটার কারণে গড় আয়ু ১৩ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস কিডনী বিকলের প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত। এ দুটি রোগ শুধু কিডনী বিকলই করে না হৃদরোগ, ব্রেইন স্ট্রোক, অন্ধত্ববরণসহ অসংখ্য রোগের জন্ম দেয়। কাজেই এদের হাত থেকে বাঁচতে হলে রক্ত চাপ এমন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেন তা ১৩০/৮০ নিচে থাকে। এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যাতে হিমুগ্লোবিন লেভেল ৭ এর নিচে থাকে।
সুপ্ত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে আমাদের দেশের প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ ভাগ লোকেরই উচ্চ রক্তচাপ আছে। কিন্তু শতকরা ৫০ভাগ এর অধিক লোকই জানেন না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। কারণ এর কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তাই সুপ্ত রক্তচাপ নির্ণয়ের জন্য বছরে ৩/৪ বার রক্তচাপ মাপিয়ে নেয়া উচিত।
স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
পরিমিত সুষম খাবার সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে যে, অতি ভোজন ও অতি ওজন স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। খাবারের সাথে আলগা লবণ পরিহার করতে হবে। অতি মসলাযুক্ত, বেশি ভাজা পোড়া খাবার, অতিরিক্ত ঝাল এবং প্রাণিজ তেল যেমন গরু খাসির চর্বি, ঘি, মাখন নিয়ন্ত্রণ করে খেতে হবে। শুধু পরিমাণে বেশি ও দামি খাবার খেলেই সুখাদ্য হয় না। খাবারের মধ্যে ৫টি উপাদান আছে কি না তা সবসময়ই খেয়াল রাখতে হবে।
যেমন শর্করা জাতীয় : ভাত, রুটি, পিঠা
আমিষ জাতীয় : মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল
স্নেহ জাতীয় : সয়াবিন, সরিষার তেল, সানফ্লাওয়ার
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা
পানির অপর নাম জীবন। কিডনী সচল রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত। একজন বয়স্ক লোকের প্রতিদিন দেড় থেকে তিন লিটার পানি পান করা উচিত। তবে যাদের কিডনীতে পাথর আছে যাদের প্রশ্রাবে ঘন ঘন ইনফেকশন হয়, যারা রোদে এবং কলকারখানায় কাজ করে তাদের পানি আরও বেশি পরিমাণ খেতে হবে, যাতে প্রস্রাবের রং পানির মত থাকে অথবা এক থেকে দেড় লিটার প্রস্রাব হয়। তবে যাদের শরীরের অতিরিক্ত পানি জমা আছে তাদের ডাক্তারের নির্দেশ মতো পানি পান করতে হবে।
ধূমপান থেকে বিরত থাকা
একটি জনপ্রিয় প্রবাদ বাক্য হচ্ছে - ‘ধূমপানে বিষপান’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর শুধু ধূমপানের জন্য সারা বিশ্বে মৃত্যু হয় ৬৬ লক্ষ মানুষের। ধূমপানের ফলে কিডনী বিকল হয়, কিডনীতে ক্যান্সার হয় , কিডনী ও মূত্রণালিতে ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। এছাড়া ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সার, মুখ ও খাদ্যনালির ক্যান্সার, হৃদরোগ, ষ্ট্রোকসহ অসংখ্য মরণব্যধির কারণ। কাজেই এসব রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে ধূমপান পরিহার করতে হবে।
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধ সেবন না করা
দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন ব্যথা-বেদনার ট্যাবলেট খাওয়ার ফলে কিডনী বিকল হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ১০ থেকে ১৫ ভাগ কিডনী বিকল হয় ঔষধ খাওয়ার কারণে। এছাড়াও এন্টিবায়োটিকসহ অনেক ঔষধ কিডনীর মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। এই ক্ষতির মাত্রা ঔষুধের মাত্রা ও কতোদিন খাচ্ছে তার ওপর অনেক সময় নির্ভর করে। আবার অনেক সময় এলার্জির কারণে স্বল্প মাত্রার ঔষধেও কিডনী বিকলের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কাজেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধ সেবন করা উচিত নয়।
নিয়মিত কিডনীর কার্যকারিতা পরীক্ষা করাঃ
কিডনী রোগ কে বলা হয় নীরব ঘাতক। কারণ ৭০ থেকে ৮০ভাগ কিডনী নষ্ট হওয়ার আগে অনেকসময় কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। অথচ সামান্য রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করেই এ রোগ সুপ্ত অবস্থায় দেহে আছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়। কাজেই যাদের মধ্যে কিডনী রোগের ঝুঁকি বেশি- যেমন যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আছে, যাদের মুখ ও শরীর ফুলে গেছে, যাদের কিডনীতে পাথর আছে, যাদের প্রস্রাবে বাঁধা জনিত রোগ আছে, প্রস্রাবে যাদের ইনফেকশনের ইতিহাস আছে, যাদের বংশে কিডনী রোগের ইতিহাস আছে, যাদের বয়স ৪০ এর উপরে তাদের বছরে দুই বার কিডনী পরীক্ষা করিয়ে নেয়া উচিত।
স্বাস্থ্য একটি অমূল্য সম্পদ এই সম্পদ সংরক্ষণের জন্যে উপরে উল্লিখিত পরামর্শ সমূহ যদি জীবনের শুরু থেকেই মেনে চলা যায় তাহলে শুধু কিডনী নয় সকল অসংক্রামক ব্যাধি থেকেই নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। কাজেই আসুন সকলেই নিয়মগুলো মেনে চলার চেষ্টা করি। এতে অর্থ ব্যয় হবে সামান্যই। তবে যে উপকার পাওয়া যাবে তা অমূল্য।
লেখক : এমবিবিএস, এমডি, এফসিপিএস, এফআরসিপি। সভাপতি, কিডনী এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস)।
এইচআর/জেআইএম