ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ইসি-ভিসিতে নির্বাসনের পথে নির্বাচন

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ১৩ মার্চ ২০১৯

প্রায় ২৯ বছর (২৮ বছর ১০ মাস) পর বন্ধ্যাত্ব কাটানোর নামে ডাকসু নির্বাচনটাকে ডেকে এনে এভাবে সর্বনাশ করা কি জরুরি ছিল? তা কার স্বার্থে? কোন মতলবে? ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচন, এরপর ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচন, প্রথম পর্বের উপজেলা নির্বাচনের পর পর ডাকসু নির্বাচনের ঘটনা বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সঙ্গে উদ্বেগও। ভোট ও নির্বাচনী ব্যবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে- এ নিয়ে সচেতনদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও কিছু একটা ধারণা করে নিয়েছে।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ধারণা বাস্তবের সঙ্গে মিলনসই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে সিলযুক্ত ব্যালটের ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে । বলার অপেক্ষা রাখে না সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থার হাল বড় করুণ। তা শূন্য থেকে মাইনাসের পথে। মুখ জোরে কথাশিল্পীদের ভাষায় বলা যায়, মানুষ এখন এত্যো এত্যো সুখে আছে, তাই নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামায় না।

মানুষ নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না, এ কথা একেবারে অসত্য নয়। কি কারণে তারা এ মনমর্জিতে এসে ঠেকেছে এর কারণের সর্বশেষ একটি ডাকসু নির্বাচন। এতে ভোট প্রথা বাতিল করতে হবে না। নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে না। একদিন আপনা থেকেই তা বাতিল হয়ে নির্বাসনে চলে যাবে।

নির্বাচনী আলোচনায় মধ্যরাত, মিডনাইট ভোট ধরনের শব্দ ভর করেছে ৩০ ডিসেম্বর থেকে। বলা হয়ে থাকে ৩০ ডিসেম্বরের ভোটের বেশির ভাগ কাজ ২৯ ডিসেম্বর রাতেই করে নেয়া হয়েছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ করে একে ‘সেরা নির্বাচন’ বলে দাবি করা হয়েছে। চমৎকার নির্বাচন করায় ভোজ উৎসবও হয়েছে। পরে মাত্র ক’দিন আগে মুখ ফসকে বা বাতকে বাত রাতের ভোটের কথা স্বীকার করে ফেলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা।

তিনি বলেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএমে ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় সিইসি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সমাজের মধ্যে অনিয়ম ঢোকে। তা প্রতিহত করতে পদক্ষেপ নিতে হয়। এ কারণে কমিশন ভাবছে ইভিএমে ভোট নেওয়া শুরু করবে।

সিইসির দুয়েকদিন আগে কমিশনার শাহদাত হোসেন চৌধুরী সুনামগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচনের আগের রাতে ভোটবাক্সে ব্যালট ভরে দেয়া এবং ভোটের পরে গণনার সময় কোনো অনিয়ম মেনে নেয়া হবে না। তিনি হুঁশিয়ারিটা দিয়েছিলেন প্রথম পর্বের উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে। তারও আগে ক্ষমতাসীনদের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রাতে নয় দিনের বেলায় ভোট ডাকাতি হবে।

রাশেদ খান মেনন মন্ত্রীত্ব হারিয়ে প্রলাপ বকছেন বলে তার অভিযোগ তুরি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু সিইসির কি হলো? তিনি তো পদ হারাননি। কিসে ভাগে কম পড়েছে তার? সব কিছু সেরে- সুরে এখন বলছেন রাতের বেলায় ব্যালট বাক্স ভরা বন্ধ করতে হলে ইভিএম চালু করতে হবে।

২৯ তারিখ রাতে ব্যালট বাক্স ভরার কাজ তো লাইট জ্বালিয়ে সশস্ত্র নিরাপত্তায় প্রকাশ্যেই করা হয়েছে । ইসির কাজ ছিল সেই ভোট বাতিল করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা । সেটা না করে কিংবদন্তীর ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেননের মতো সাধু সাজার চেষ্টা করে কি লাভ তার?

গুণে-মানে সিইসি নুরুল হুদাকে ছুঁয়ে ফেলেছেন ডাকসু নির্বাচনের অভিভাবক ভিসি ড. আখতারুজ্জামান। ভৌগোলিকভাবে তারা কাছাকাছি মানুষ। দুজনেরই বাড়ি বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ক্যাম্পাসে ভিসিকে নিয়ে রসিকতার অন্ত নেই। মজা করে বলা হয়, আল্লাহ কোন মাটি দিয়ে তাকে তৈরি করেছিলেন তা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ছাড়া বোঝা কঠিন।

লাজ লজ্জা না-কি তাকে স্পর্শ করতে পারে না। ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, এ জন্য তিনি আনন্দিত-এমন প্রতিক্রিয়া দেয়া কিভাবে সম্ভব হলো তার পক্ষে? তাকে এখন তার নিয়োগকর্তা শক্তির প্রতি এভাবে নুইয়ে পড়ে আজ্ঞাবহতার পরিচয় দিতে হবে? এর দায় কে নেবে?

ঐতিহ্য, চেতনা ও প্রাণের ডাকসুকে এভাবে কলঙ্কিত করার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়েও কালিমা কম পড়েনি। ভোট এখন যে জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, এ নিয়ে মানুষের গরজ কম থাকলেও শিক্ষকদের প্রতি সম্মান হারিয়ে যায়নি। এ হীন কাজে জড়িত শিক্ষকরা এখন কিভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াবেন, সদা সত্য কথা বলবে, কদাচিৎ মিথ্যা বলবে না।

জাতীয়-স্থানীয় নির্বাচনে এমন নোংরামির পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছুটা হলেও আগ্রহ অবশিষ্ট ছিল। মনে করা হয়েছিল যেহেতু এখানে হুদা কমিশন নেই, ফলে ডাকসু নির্বাচনটি ভালো হতেও পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা হুদা কমিশনের পথেই হাঁটলেন।

ডাকসু নির্বাচনে এমন কিছু হওয়ারই শঙ্কা ঘুরছিল গত ক’দিন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর ছাত্রলীগ মিলে একপক্ষ। বাদবাকিরা সবাই এক পক্ষ হয়ে বর্জন করেছে এ নির্বাচন। অনিয়মের অভিযোগের পাশাপাশি পুনর্নির্বাচনের দাবিতে তারা এরইমধ্যে ধর্মঘট করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের মার্চ মাসের ১১ তারিখে এসে আরেকটি ৩০ ডিসেম্বরই হলো কি-না-? সেই নির্বাচনের প্রভাব এর পরের সব নির্বাচনের ওপরে পড়েছে। নির্বাচনগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি ধারাবাহিকভাবে শুধু কমেছে। ভোটার না এলেও কাস্টিং ভোটের কমতি নেই।

জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে উপজেলাসহ স্থানীয় নির্বাচনে কিছুটা তফাৎ ঘটেছে। এখানে অংশ নিচ্ছে শুধু ক্ষমতাসীন দল ও জোটের শরীকরা। ফলে এটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থী ৫ শতাংশ ভোট পেলেও জিতছেন, জিতবেন। নির্বাচনে ভোটারশুন্য ভোটকেন্দ্র নিয়ে কেউ বলছেন, গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। কেউ বলছেন- ‘ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কারো বাণী- দায় প্রার্থীদের। আর সিইসি বলেছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের ধরে আনা কমিশনের কাজ নয়।

উপরোক্ত এসব কোনো বাণী- মন্তব্যই ফেলনা নয়। গোটা ব্যবস্থা ও অবস্থা দেশকে ভোট ও নির্বাচনহীনতার পথেই নিচ্ছে কি-না, সেই প্রশ্ন জোরদার হলেও চুপসে থাকাকেই শ্রেয়জ্ঞান করছেন সতর্করা। রাতের বেলার ভোট আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভোটের পরে এবার জোর- জবরদস্তির এই নির্বাচনী সংস্কৃতি ভয়ানক কোন অন্ধকারকে আমন্ত্রিত করছে কি-না, শঙ্কা জাগছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন