নতুন মেয়রের ছায়াসঙ্গী তাঁর স্বপ্নচারী পূর্বসূরি
স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে মানুষ। স্বপ্নের সঙ্গেই তার বসবাস। কিন্তু এই আমরা, যারা ঢাকা শহরে বসবাস করি তারাও স্বপ্ন দেখি আমাদের এই মহানগরী আরও বসবাস উপযোগী হবে। যদিও প্রতি বছর বসবাসের জন্য ভালো নগরীর তালিকা প্রকাশের পর আমাদের প্রাপ্তি হতাশার বৃদ্ধি।
বসবাস উপযোগী শহরের তালিকার তলানিতে জায়গা পাচ্ছে আমাদের ঢাকা। চারশ বছরের পুরনো এক শহর। যে শহরকে তিলোত্তমা বানাতে চেয়েছেন। কেউ আধুনিক ঢাকা বানাতে চেয়েছেন। জনবিস্ফোরণে ক্ষত-বিক্ষত ঢাকার দেখভালটা যাতে ঠিকমত হয়, তার জন্য তাকে দ্বিখণ্ডিতও করা হয়েছে।
শহরভাগের ক্ষত বুকে নিয়ে আমাদের ঢাকার প্রশাসনিক ঠিকানা উত্তর সিটি করপোরেশন আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ঢাকার বাসিন্দারাও এখন আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ উত্তরের। কেউ দক্ষিণের। কিন্তু তাতে কী ঢাকার ইতিবাচক কোন পরিবর্তন হলো! হয়তো হয়েছে। হয়তো বা হয়নি।
তবে ঢাকাবাসী পেয়েছে দুই দুইজন নগরপিতা। লম্বা সময় নগরপিতাহীন ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারা। উপ-নির্বাচনে তারাও পেলেন নতুন নগরপিতা। আনিসুল হকের মৃত্যুর পর বার বার পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-নির্বচান হল। নতুন নগরপিতা নির্বাচিত হলেন আতিকুল ইসলাম। নির্বাচনের আগে তিনি বার বার একটা কথা বলেছেন, 'আনিস ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।'
এই বাক্যটার মধ্যে অনেক রকম ব্যাখ্যা আছে। বহুভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। ইতিবাচকভবাবে দেখলে স্বীকার করতে হবে সত্যি-ই আনিসুল হক ঢাকার উত্তরাংশ নিয়ে নতুন কিছু ভেবেছিলেন। নতুন কিছু করেছিলেন যা নগরবাসীর পছন্দের ছিল। একই সঙ্গে তিনি অল্প দিনেই বোঝাতে পেরেছিলেন নগরপিতা চাইলে, সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে সত্যি এই ঢাকার বুকে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগানো সম্ভব। তিনি কিছুটা লাগিয়েছিলেন। তাই তাঁর কাজগুলোকে মডেল করেই হয়তো নতুন মেয়র কিছু করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন।
আনিসুল হক কি করেছিলেন সেটা বড় কথা নয়। বছর দেড়েক সময় তিনি একটা কাজই করেছিলেন মানুষের মনে একটা আস্থা ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলেন। হ্যাঁ, আপনারা পাশে থাকলে আপনাদের জন্য আমি কিছু করতে পারবো। অর্থাৎ, তার ইচ্ছাটা জনমানসে ফিল্টারিং হয়ে সেটা সদিচ্ছা-ই মনে হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ অসুস্থতার পর আনিসুল হক কফিনবন্দী হয়ে দেশে ফেরার পর তার স্বপ্নগুলো মনে হয়েছিল কফিনবন্দী! ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে আছে তাঁর অনেক প্রকল্প। সেরকম একটা অবস্থায় দায়িত্ব পেলেন আতিকুল ইসলাম। আনিসুল হকের স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে এবার সেই সব ফাইলের কফিন খোলার দায়িত্ব তাঁর।
আতিকুল ইসলাম পারবেন। এমন আশা করতে কোন দ্বিধা কাজ করছে না মনে। কারণ, তার পেছেনও আছে সাফল্যের অনেক কাহিনী। আছে সরকার। আছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী নিজেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে থাকেন। যদিও তিনি বাসিন্দা ঢাকা দক্ষিণের। ঢাকার নাগিরক সুযোগ-সাবিধা বাড়ানোর চেয়ে অসুবিধাগুলো দূর করাই হবে নতুন মেয়রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অবৈধ দখলদারিত্ব মুক্ত করাই বড় চ্যালেঞ্জ নয়। বরং তারচেয়ে অনেক কঠিন কাজ ঢাকাকে পরিকল্পিত নগরীর অবয়ব দেয়া।
ঢাকা বেড়েছে। আর সেই বাড় বাড়ন্ত ঢাকার বুকে দাঁড়িয়েছে নতুন নতুন সিটির বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ড। যেখানে লেখা কত স্বপ্নের বাড়ির ঠিকানা! এই বিজ্ঞাপনের দৃশ্যগুলোর ভাষা যাই হোক, কিন্তু সেই সাইবোর্ডগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ধরনের আধিপত্যবাদ। আছে দখলদারিত্ব। এই অধিপত্যবাদকে যারা পুঁজি করে সাইবোর্ড আর বিজ্ঞাপনে ঢেকে দিচ্ছে ঢাকার মুখ। তাঁদের ক্ষমতার উৎসমুখ রাজনীতি।
সেই সব ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঢাকা গড়ার কাজ অসম্ভব হয়তো না। তবে শুধু কঠিন নয়। বেশ কঠিন। সেটা শপথ নেয়ার আগেই উত্তর ঢাকার নতুন নগরপিতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাই শুরুতেই হুঁশিয়ারিটা উচ্চারণ করে রেখেছেন। মুখের কথা আর কাজের মাঝে তফাৎ কতটা সেটা বোঝা যাবে চেয়ারে বসার পর।
আতিকুল ইসলাম সফল ব্যবসায়ী। ক্রীড়াঙ্গনেও তার বিচরণ। সেখানেও তার কম বেশি সাফল্য। রাজনৈতিক দলের মেয়র হয়ে রাজনীতির ময়দানে এটাই হতে যাচ্ছে তাঁর প্রথম ইনিংস। এখানে সাফল্যের জন্য তাঁকে অনেক উজান ঢেলে এগুতে হবে। অনেক প্রতিকূলতার পাশে তিনি দেখবেন সাধারণ মানুষের অনেক আকুলতা।
আমরা বসবাসযোগ্য একটা নগর চাই। যে নগরের কিছুটা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আগের নগরপিতা। সেই জনআবেগ পড়ে নেয়ার মত ক্ষমতা-বিচক্ষণতা-দক্ষতা আতিকুল ইসলামের আছে। সেই বিশ্বাস হারাতে চান না এখনও এই শহরের মানুষ। কিন্তু তাঁদের বিশ্বাসের মূল্য দেয়ার দায়িত্ব নতুন নগরপিতার।
যে ঢাকা শহরের দিকে তাকালে শঙ্খ ঘোষের কবিতার কথা মনে পড়ে বার বার; 'ভাবি আমার মুখ দেখাবো, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।' সত্যিই ঢাকার মুখ ঢেকে আছে বিজ্ঞাপনে। কী লেখা আছে সেই সব বিজ্ঞাপনে সেটা যে যার মত করে পড়ে নিচ্ছেন। বুঝে নিচ্ছেন। তবে নির্বাচনের আগে আপনার পোস্টারের কথাগুলো নিছক ভোটের বিজ্ঞাপন ছিল না, সেই ব্র্যান্ড ইমেজটা তৈরির দায়িত্ব আপনার। মডেল-তারকারা আপনার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে পারবেন। কিন্তু নিজের ব্র্যান্ড নিজেকেই তৈরি করতে হবে। সেটা আপনার জানা।
সেই সঙ্গে নতুন নগরপিতাকে একটা পুরনো কথা নতুন করে জানাতে চাই। বৃষ্টিভেজা দিনে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী কে ছিলেন মানুষ তা ভুলে গেছেন। কিন্তু একজন ছায়া প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু নগর ভবনে আপনাকে তাড়া করে বেড়াবেন। তিনি আপনার পূর্বসূরি। যিনি ঢাকার উত্তরাংশের মানুষকে নতুন এক ঢাকার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস