সৃষ্টিকর্তা তাঁর ইচ্ছেই পূরণ করলেন…
২৮ শে ফেব্রুয়ারি সারাদিন আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গেই ছিলাম। তিনি আগে আর আমরা তাঁর পেছনে অসংখ্য গুণগ্রাহী। তাঁর সঙ্গে ভ্রমণ, আমার কাছে নতুন কিছু না। এবার শুধু পার্থক্য ছিল অন্যসময় থাকতাম তাঁর গাড়িতে। এবার আর পারিনি। ফ্রিজিংভ্যানে তিনি ছিলেন শুধু একা।
এই অগস্তযাত্রায় চাইলেও কেউ সঙ্গী হতে পারে না। প্রাণি মাত্রই এই যাত্রায় শামিল হতে হবে জানি। কিন্তু দেশের মানুষের গড় আয়ু যেখানে ৭০ এর বেশি, সেখানে মাত্র ৬২তে এই যাত্রা? উনিতো একা থাকা পছন্দ করতেন না। নিজে সারাক্ষণ হাসতেন এবং চার পাশে হাসিমুখ দেখতে চাইতেন। তাহলে কেন এই অবিচার? কার কাছে তাঁর এই অকাল মৃত্যুর বিচার চাইবো?
২০০২ এর শেষের দিকে কোন এক সন্ধ্যায় চ্যানেল আই এর সে সময়ের বার্তা পরিচালক শাইখ সিরাজ আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি কোন একটা নিউজের রানডাউন দিচ্ছিলেন। সেই ব্যস্ততার মধ্যেও জেনে নিয়েছিলেন আদ্যোপান্ত। তারপর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কী করতে হবে। খুব সহজ করেই সেদিন বলেছিলেন আমার কাজটি কত কঠিন হবে। যখন বললাম আমি টিভিতে নতুন, তিনি বললেন “শুধু চাকরি করো না, শুরু থেকে কাজে সময় দাও, শিখে যাবে”।
এই যে তিনি বললেন “কাজে সময় দাও” এই তিনটি শব্দের মধ্যে আটকে ছিলেন আলমগীর ভাই। নিজে সারাদিন কাজের মধ্যে থাকতেন। চাইতেন সহকর্মীরাও যেন থাকে । ২০০২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত টানা ১০ বছর তাঁর সঙ্গেই ছিলাম চ্যানেল আই, একুশে, যমুনা, মাছরাঙ্গায়। তাঁর সম্মতিতেই এসেছিলাম ৭১এ । বছর খানেক পর যুক্ত হয়েছিলেন পিআইবিতে। পিআইবি’র সঙ্গে আমার আগে থেকে কাজের সম্পর্ক ছিল। আলমগীর ভাই যুক্ত হওয়ার পর সেই মাত্রা আরো বাড়ে।
সত্যি বলতে কী ২০০২ থেকে ২০১৯ এই টানা ১৭ বছর শুধু কাজই করেছি আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে। এই দীর্ঘ সময়ে যত বৈঠক, যত ভ্রমণ এমনকী ব্যক্তিগত কথা বার্তায়ও কাজ ছাড়া আর কিছু ছিল না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এত কাজের কথায় কখনো একঘেয়েমি লাগেনি। কারণ তিনি জানতেন কাজ কী ভাবে আনন্দময় করে তুলতে হয়। নিউজরুমে তো দেখেছিই, দেখলাম পিআইবিতেও। সামনে বসিয়ে কথা বলছেন আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফাইল দেখছেন। ছুটির দিনগুলোতে চলে যাচ্ছেন ঢাকার বাইরের ট্রেনিংএ। এক সফরে তিন চারটা ট্রেনিংএ যোগ দিয়েছেন এমন নজিরও আছে।
আলমগীর ভাই সম্পর্কে এই লেখা পড়তে গিয়ে অনেকের মনে হতে পারে, আমি আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির কথাই বেশি বলছি। আসলে তার সম্পর্কে জানার জন্যে তার কাছাকাছি যারা ছিলেন তাদের দেখা বর্ণনা ছাড়া উপায় নেই। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে অন্য অনেকের মত তার নিজের কোন বই বা লেখা পাওয়া দুস্কর । কতবার অনুরোধ করেছি, ভাই যেগুলো বলছেন, এগুলো লিখে ফেলেন। বলতেন, লিখলে তো হতো, কিন্তু সময় কই? আসলেই আলাদা করে সময় বের করার সময় আলমগীর ভাইয়ের ছিল না।
নিউজরুম ছাড়তেন রাত ১১টার পর আর আসতেন ১১টার মধ্যে। কোন কোন দিন সকালেই চলে আসতেন। এর মধ্যেই ছিল, ইউনিয়ন প্রেসক্লাব সবশেষ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট । এছাড়া প্রতিদিন আমার মত অসংখ্য সাঙ্গপাঙ্গ’র উৎপাত তো ছিলই। এছাড়াও কথা বলতেন সারাদেশ থেকে দেখা করতে আসা সাংবাদিকের সঙ্গে। থাকতেন সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের সঙ্গেও।
আমি টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে পেয়েছি আলমগীর ভাইকে। সবসময়ই দেখেছি তিনি বার্তাকক্ষের প্রতিদিনের কাজের পাশাপাশি সাংবাদিকতার সার্বিক উন্নয়নের বিষয়টি মাথায় রাখতেন। এর মধ্যে ঢাকায় যিনি বা যারা কাজ করছেন তাদের কথাও যেমন ভাবছেন, প্রত্যন্ত দূরের জেলা বা বিভাগে যিনি কাজ করছেন তিনিও বাদ পড়ছেন না। খেয়াল করতেন ঢাকার বাইরের যারা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে কেউ খারাপ আচরণ করছেন কী না। কোন কারণে করে ফেললে ডেকে বুঝিয়ে বলতেন, কেন এরকম করা উচিত না।
পিআইবিতে যুক্ত হওয়ার পর দেখলাম সাংবাদিকদের ভাল কীসে হবে সেই বিষয়টি নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলেন। মনে হলো এত যেন এই সুযোগটির অপেক্ষায় ছিলেন। আমরা যারা তার কাছে ছিলাম তাদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন। যার পক্ষে যতটুকু দেয়া সম্ভব বের করে নিলেন। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেই কাজটি করছিলেন একজন ধ্যানী তপস্যীর মত। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় যারা ইতিবাচক বদল এনেছেন, বিশেষ করে টেলিভিশন সাংবাদিকতায়, তাঁদের মধ্যে আলমগীর ভাই অন্যতম।
আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে সবশেষ কথা হয়েছিল তাঁর সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে। পরে ফোনে দু’তিনবার কথা হয়েছে। সে নেহায়েত নিয়মিত সৌহার্দ্য বিনিময়। কিন্তু মনে রাখার মত কথাটি হয়েছিল মুখোমুখি কথা বলার সময়। জিজ্ঞাসা করেছিলাম শরীর এখন কেমন? বললেন, দেখ শরীরের একটা রোগ হয়েছে। আমি শুরু থেকেই চিকিৎসা করাচ্ছি। একে সর্বোচ্চ চিকিৎসা বলতে পার। সারলে সারবে না সারলে আর কী.... বলে সেই মন ভোলানো পরিচিত হাসিটা দিলেন। সেই হাসি মুখটাই এখনো ঘুরছে মাথার মধ্যে।
প্রায় বছর দেড়েক আগে থেকে তিনি রক্ত রোগের চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। আমি জানতাম। সবই বলতেন, কিন্তু আচরণে কখনো মনে হতো না তাঁর বড় কিছু হয়েছে। অফিস থেকে হাসপাতালে যাচ্ছেন। আবার অফিসে আসছেন। যেন পাত্তাই দিচ্ছেন না শরীর খারাপটাকে। কিন্তু সেদিন খানিকটা পাত্তা দিলেন। কিন্তু তাঁর বলার ধরনের কারণে আমি বুঝলাম না। তাছাড়া তাঁর যে আকস্মিক মৃত্যু হওয়ার মত কোন রোগ হতে পারে সেটা আঁচ করার কথাও নয়। কারণ তিনি ছিলেন খুবই নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের মানুষ। চার পাশে এত গুণগ্রাহী এত ভক্ত কেউ বুঝলো না ভেতরে ভেতরে তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন।
আরেকদিন কাজের ফাঁকে বলছিলেন, মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য কী জান, কোন মানুষ যদি কাজ করতে করতে মারা যায়। সেদিনও বুঝিনি তাঁরও ইচ্ছে ছিল এভাবে কাজ করতে করতে চলে যাওয়া। সৃষ্টিকর্তা শেষ পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছেই পূরণ করলেন। কিন্তু আমার মত অনেককেই করলেন অভিভাবকহীন।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন।
[email protected]
এইচআর/এমএস