একুশ মানে মাথা নত না করা
আজ মহান একুশে। মহান শহীদ দিবস। সেই সঙ্গে গোটা বিশ্বব্যাপী দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালন করা হচ্ছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে সালাম বরকত রফিক জব্বার তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার।
বাঙালি ছাড়া আর কোনো জাতি তার নিজের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেনি, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেয়নি। একারণে বাঙালির এই মহান আত্মত্যাগকে গোটা বিশ্ব স্মরণ করবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে। তারা জানবে আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা। তারা জানবে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিসত্তার কথা।
পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় সফরে এসে তার বক্তৃতায় ঘোষণা করেন-'একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।' সেদিন ‘নো নো’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করেছিল এদেশের ছাত্রযুবকেরা।
এরপর নানা সংগ্রাম আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। এর জন্য রক্ত ঝরাতে হলেও বাঙালি এক দারুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। একুশ তাদের এমনি সাহসী করে তোলে যে, এরপর বলা হতে থাকে ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। এই উন্নত শির জাতিই পরে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়। বস্তুত একুশের পথ ধরেই এসেছে আমাদের স্বাধীনতা।
যে চেতনাকে ধারণ করে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল তার কতোটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে এই ৬ দশকে সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্ন আজ জাতির সামনে। এছাড়া বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশটির বয়স এখন চল্লিশ বছর। স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমেই প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ণতা পায়। এ কারণে আশা করা হয়েছিল রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।
দেশের সকল মানুষ তার নিজের ভাষায় লেখতে পড়বে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হয়েছে? এর উত্তর হবে- না হয়নি। এখনও সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। উচ্চ আদালত, প্রশাসনসহ সর্বত্র এখনো ইংরেজির দাপট। এমনকি ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র পর্যন্ত লেখা হয় ইংরেজিতে। সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ফেস্টুন, বিজ্ঞাপনেও ইংরেজির ছড়াছড়ি।
যদিও এদেশের সিংহভাগ মানুষ এখনও অক্ষর জ্ঞানহীন। তাই ভাষা আন্দোলন এখনও শেষ হয়ে যায়নি। যতোদিন একজন মানুষও নিরক্ষর থাকবে ততদিন ভাষা আন্দোলন চলবে। এর চেতনাকে ধরে রাখতে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিটি মানুষকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তুলতে না পারলে, তাদের শিক্ষিত করে তোলা না গেলে ভাষা শহীদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে না। তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শনও সম্ভব হবে না।
শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যে বিষয়টি যুক্ত তা হলো নিজস্ব ভাষা। ভাষা মানুষের আত্মবিকাশের পথকে সম্প্রসারিত করে। এ জন্য একজন মানুষ তাঁর ভাষা প্রয়োগে যতোটা দক্ষতা অর্জন করবেন জীবনের নানা ক্ষেত্রে তিনি একটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন।
এজন্য বাস্তবিক কারণেই একজন আধুনিক মানুষকে আরও দক্ষ, যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য ভাষার ওপর পূর্ণ দখল থাকা চাই। সেটা অবশ্যই তার মাতৃভাষা। এরসঙ্গে অন্যভাষা যতো শেখা যায় ততই ভাল।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি- ‘মোদের গরব, মোদের আশা,আ মরি বাংলা ভাষা।’ তাই শুরুতেই এই বাংলা ভাষার গাঁথুনি শক্ত করতে হবে। পরে ইংরেজি কিংবা অন্যান্য ভাষার গোড়াপত্তন করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমস্যা হচ্ছে নতুন প্রজন্ম না বাংলা না ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালোভাবে শিখছে না। তারা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম দিচ্ছে। এতে ভাষা বিকৃতি ঘটছে চরমভাবে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। ফেসবুক ইন্টারনেটে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুদ ভাষা। রোমান হরফে বাংলা লেখা হচ্ছে। সেই বাংলার ধরনও আবার বড়ই বিচিত্র। ইদানীং চালু হওয়া এফএম রেডিওর বিরুদ্ধে ভাষা বিকৃতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এ জন্য গণমাধ্যমের ভাষার ব্যাপারে একটি নীতিমালা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার বিশেষ করে যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর প্রযোজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তাই বলে নিজস্ব সত্তা বিসর্জন দিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে হবে? এই আত্ম বিনাশের পথ থেকে আমাদের ফিরে আসতেই হবে। লেখায়, বলায় পঠনে পাঠনে সর্বত্র বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মর্যাদার আসনে।
মনে রাখতে হবে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন কেবল আমাদের নিজস্ব ব্যাপার নয় এটি এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও। এমনকি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে দাবি জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের ৬৬তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে বাংলাভাষায় দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দাবি জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের প্রায় তিনশ’ মিলিয়ন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। আমি বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দিতে আমাদের আবেদনের প্রতি সকলের সমর্থন কামনা করছি। আজকে আবারও সেই প্রস্তাবের পক্ষে আপনাদের সমর্থন কামনা করছি। এর আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দেন।
ইতিমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ভিত্তিতে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এরই আলোকে বাংলাকে জাতি সংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা অত্যন্ত যৌক্তিক বলে আমরা মনে করি।
ভাষা আন্দোলনের আরেক প্রাপ্তি হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থ মেলা। বাঙালির কোনো সাংস্কৃতিক উৎসব নেই। সেদিক থেকে বাঙালির প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবও এই বইমেলা। বইমেলা জড়িত বাঙালির চেতনা এবং আবেগের সঙ্গে। বাঙালির যত আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস ঐতিহ্য তা সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়েই।
বইমেলা সাংস্কৃতিক জাগরণে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষা সংস্কৃতির প্রতি আবেগ এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক উদার চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে একুশে বইমেলা রূপ নিয়েছে বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে। এখানে শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা-পাঠকেরই সমাগম হয় না, মেলা পরিণত হয় লেখক-প্রকাশক-পাঠক, দর্শকসহ বয়স শ্রেণী নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মিলন মেলায়।
সৃজনশীল প্রকাশকরা হাজারো বইয়ের পসরা নিয়ে হাজির হন বইমেলায়। মেলায় আগত দর্শক সমাগম নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে সারাদেশের অগণিত গ্রন্থ পিপাসুর নতুন বই হাতে পাওয়ার বিপুল আকাঙ্খাকে। একুশের চেতনাসমৃদ্ধ মেলাকে কীভাবে আরও সম্প্রসারণ করা যায়, এর শ্রী বৃদ্ধি করা যায় এ নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই সময়ের অভিঘাতে সবকিছু পাল্টাচ্ছে। মানুষের রুচি ও মূল্যবোধও পাল্টাচ্ছে। যে কারণে এর সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য বইমেলার চেতনা, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। বইকেন্দ্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণে বইমেলা যেন আরও বেশি অবদান রাখতে পারে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাসব্যাপী বইমেলা উদ্বোধনকালে জ্ঞানভিত্তিক একটি সমাজ গড়ে তোলার তাগিদ দেন। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে এখনও সিংহভাগ মানুষ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। কাজেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের সঙ্গে সকলকে শিক্ষিত করে তোলার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
শিক্ষিত জাতি ছাড়া একটি উন্নত সমাজ ব্যবস্থার কথা চিন্তাও করা যায় না। এ জন্যই বলা হয় যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। এ জন্য শিক্ষার হার বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এ যাত্রায় শামিল করতে হবে।
আমাদের দেশে অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যে বিষয়টি যুক্ত তা হলো নিজস্ব ভাষা। বিশেষজ্ঞের মতে ‘ভাষার অসামান্য গঠনের কারণে একটি গোষ্ঠী তৈরি হয় সেই সব ব্যক্তিদের দিয়ে যারা এভাবে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম। আদিম অবস্থায় প্রত্যেক গোষ্ঠীরই তা যতই ছোট হোক না কেন, নিজস্ব ভাষা বা উপভাষা আছে।’
বাংলাদেশে বসবাসরত প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকলেও এদের মধ্যে অধিকাংশের ভাষারই নেই নিজস্ব বর্ণমালা। লিখিত রূপ না থাকায় তাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে তাদের অবলুপ্তিও যেন ত্বরান্বিত হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাই হচ্ছে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর ভাষা হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। আর এ দায়িত্ব শুধু বাঙালির নয় পৃথিবীর সকল মানুষের।
আমরা যেন শুধু আবেগতাড়িত না হয়ে অমর একুশের কথা না বলি। একুশ তখনই সার্থক হবে যখন প্রত্যেক জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে। এই ভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পরবে। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে। তবেই সার্থক হবে একুশ। সার্থক হবে বইমেলা। এবারের একুশে এই বোধ জেগে ওঠুক সকলের মধ্যে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম