জামায়াতি লাড্ডু: হেফাজতি মোয়া
জামায়াতের দুর্গতির বিপরীতে উল্লাসভাব হেফাজতে। দিনকাল বেশ ভালো যাচ্ছে হেফাজত নেতা-কর্মীদের। নিত্য যোগ হচ্ছে নানা প্রাপ্তি। বিএনপির দীর্ঘদিনের সঙ্গী জামায়াত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার নতুন কচলানিতে এ রিলাক্স হেফাজতের। বেমালুম হয়ে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে হেফাজতি কাণ্ডকারখানার খবর। এই মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীই যেন একনম্বর এবং একমাত্র ইস্যু। হেফাজতসহ বাদবাকি সব তামাদি।
টানা নীরবতা ভেঙে হঠাৎ লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগ জামায়াতকে এনে দিয়েছে হটইস্যুতে। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি সামনে এনেছেন একাত্তরের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করা এবং দলের নাম ও নীতি পরিবর্তনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনিচ্ছার অজুহাত। এরও কদিন আগ থেকে জামায়াতের বিএনপি ত্যাগ নিয়ে আলোচনাটা জমে উঠছিল। ব্যারিস্টার রাজ্জাক তাতে দিলেন নতুন মাত্রা।
ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশ ইসলামী ধারার দলগুলোর জন্য উর্বরভূমি। কিন্তু তারা নিজস্ব প্লাটফর্ম তৈরি করতে পারেনি। ভর করেছে অন্যের প্লাটফর্মে। কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপির ওপর ভর করতে গিয়ে তাদের পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে অনেক আগেই।
ইসলামী দলগুলোর নেতাদের অনৈক্য, সংকীর্ণতা, ক্ষমতার মোহ দক্ষিণ ধারার রাজনীতি ভীতকে শুধু দুর্বল করেছে। ব্যক্তিগতভাবে নিজেরাও চলে গেছেন উচ্ছিষ্টের ভাগাড়ে। রাজনীতির বাজারের এ মন্দাদশা কাটানোর সামর্থ-প্রস্তুতি কোনোটাই আপাতত নেই ধর্মভিত্তিক দলগুলোর।
সরকারি ঘরানা, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিক, স্বতন্ত্র ধারাসহ সব ইসলামি দলেই প্রায় একই অবস্থা। আওয়ামী লীগে ভর করা দল ও নেতারা কোনো মতে টিকে আছেন টুকটাক ভাগেযোগে। অবস্থা-অবস্থান ভিন্ন শুধু হেফাজতের। এক সময় যেমনটি ছিল জামায়াতের।
রাজনীতিতে জামায়াতের উত্থান-পতন বরাবরই নাটকীয়তায় ঠাসা। সময়ে সময়ে বড় দুই দলই জামায়াতি মোয়া খেয়েছে। সমর্থন-সহায়তা দিয়ে মোটাতাজা করেছে। মণ্ডা-মিঠাই খেয়েছে জামায়াতের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। একে উত্থানের সুযোগ হিসেবে নিয়ে জামায়াত কখনো বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গী হয়ে নিজের অবস্থান পোক্ত করেছে।
যেই আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের কয়েকজন নেতার বিচার করেছে। আবার এই আওয়ামী লীগই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে জামায়াতকে সঙ্গী করতে দ্বিধা করেনি। তখন চেতনার প্রশ্ন আসেনি। যাতনাও হয়নি।
এরও আগে, এরশাদকে ক্ষমতায় রেখে বিএনপি ১৯৮৬ সালে নির্বাচন করতে রাজি না হলেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত তাতে অংশ নিয়েছিল। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে (১৯৯১-৯৬) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর পক্ষে জামায়াতের সমর্থন চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। আবার ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সংসদের ভেতরে- বাইরে সক্রিয় ছিল জামায়াত।
দক্ষিণপন্থী আরো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের উত্থানও সিনেমেটিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হেফাজতের দর্শন জামায়াতের চেয়েও পশ্চাৎপদ। ভয়ঙ্কর। কয়েক দিন আগেও হেফাজতের আমির মেয়েদের ক্লাস ফাইভের বেশি না পড়ার ফতোয়া দিয়েছেন। বারণ করেছেন নারী-পুরুষ একসঙ্গে পড়াশোনা না করার।
বলেছেন, নারী রোগীরা চিকিৎসার জন্য পুরুষ ডাক্তার দেখাতে পারবেন না। কখনো বিএনপি কখনো আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সওয়ারি হয়ে অনেক পথ মাড়িয়ে এই গোষ্টিটি এখন বলবান-ধনবান। আওয়ামী লীগ থেকে কিছুদিন আগেও বলা হতো- বিএনপি, জামায়াত-হেফাজত একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আর হেফাজতের কাণ্ডারি মাওলানা শফিকে ডাকা হতো তেঁতুল হুজুর নামে।
আবার এই হেফাজতই বিএনপির মদদে ২০১৩ সালে কী কাণ্ডকারখানাই না করেছে। ঢাকা শহরে তাণ্ডব ঘটিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষিত শিক্ষানীতি ও নারী উন্নয়ন নীতি বাতিল চেয়েছে। সেই হেফাজতকে আচ্ছা মতো জব্দই করেনি, আয়ত্বেও নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ম্যাজিক, নাটকীয়তার মতো হেফাজতও বিএনপিকে ছেড়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিতালি করেছে। তাদের আমির আল্লামা আহমদ শফী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি শোকরিয়া জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়েছেন কওমী জননী খেতাব।
নীতি-আদর্শের দুর্ভিক্ষের এ সুযোগে তারা পাঠ্যপুস্তক পাল্টে নিয়েছে সরকারকে দিয়ে। হেফাজতের দাবি মেনে সরকার পাঠ্যপুস্তক থেকেও কথিত ‘অনৈসলামিক’ রচনাগুলো বাতিল করে দেয়। এমন কি তাদের সমাবেশের সুবিধার্থে পাবলিক পরীক্ষাও স্থগিতের নজির তৈরি করেছে অসাম্প্রদায়িকতার দাবিদার সরকার।
বিএনপির এ ধরনের জামাতি-হেফাজতি অন্যান্য মিত্ররাও এখন আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ। প্রচণ্ডভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট এখন আর বিএনপির সঙ্গে নেই। খেলাফত মজলিসের একাংশও ছুটে গেছে বিএনপি থেকে।
রাজনীতির দক্ষিণ আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা ঘটাতে রাজনৈতিকভাবে সাফল্যের শীর্ষে আওয়ামী লীগ। অবশ্য নিজেদের এ পরিণতি ডেকে আনার পেছনে দক্ষিণপন্থীদের নিজেদের অবদানও ব্যাপক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লেজুড়বৃত্তির জেরে নিজেদের তেজ-জৌলুস অবশিষ্ট রাখেনি তারা।
ইসলামী দলগুলোর শিরোমনি জামায়াতে ইসলামির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বন্ধ্যাত্ব। তারওপর একাত্তর প্রশ্নে নতুন করে মতবিরোধে আক্রান্ত দলটি। গৃহহীন এই দলটির মগবাজারের কেন্দ্রীয়, পল্টনের ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশের কার্যালয়গুলো বন্ধ রয়েছে। সভা-সমাবেশ দূরে থাক, প্রকাশ্যে চলাফেরাও করতে পারে না নেতাকর্মীরা।
ইসলামপন্থী বাদবাকি দলগুলোর কর্মতৎপরতাও চক্কর খাচ্ছে বিবৃতি আর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। এবার শুরুতে আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়তে চেয়েছিল জামায়াতবিরোধী বেশ ক’টি ইসলামী দল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাদের মকসুদ হাছিল হয়নি। এখন তাদের পথহারা পাখির দশা হলেও নিবন্ধনহীন হেফাজতের অবস্থা রমরমা।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামপন্থী ১১টি। আর নিবন্ধনের বাইরে তাদের সংখ্যা অগুনতি। হেফাজতে ইসলামসহ এ ধরনের দল শত শত। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে থাকা একমাত্র ইসলামী দল বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। ১৪ দলভুক্ত বলে সংগঠনটি সভা-সমাবেশের অনুমতি চাইলেই পায়। কিন্তু রাজপথে কর্মসূচি দেয়ার মতো সামর্থ নেই দলটির।
অন্যদিকে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে রয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মতো দলগুলো। কিন্তু সভা-সমাবেশের অনুমতি মেলে না তাদের। টুকটাক বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়া ছাড়া গতি নেই তাদের। অস্তিত্ব, শক্তি, প্রভাবের পুরো বাজার, মাঠ-ঘাট একচেটিয়া হেফাজতের কব্জায়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস