ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এ কমিটি কতোটা গ্রহণযোগ্য?

আশীষ কুমার দে | প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকের ভাষায়, সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় অভিশাপ। এই অভিশাপমুক্তির জন্য সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে গঠিত হয়েছে দুটি কমিটি; যার একটি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, দুর্ঘটনাবিরোধীদের প্রতিপক্ষরা এ কমিটিতে কেনো?

জানুয়ারিতে ৩৮৩টি দুর্ঘটনায় ৫৩ নারী ও ৭১ শিশুসহ ৪১১ জন নিহত এবং ৫৮ নারী ও ৪০ শিশুসহ ৭২৫ জন আহত হয়েছে। আর চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে ২৩৯টি দুর্ঘটনায় ৩৯ নারী ও ৩৩ শিশুসহ ২৩৯ জন নিহত এবং ৫৮ নারী ও ৫৮ শিশুসহ ৫৭৪ জন আহত হয়েছে (সূত্র: নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি)।

এভাবে বহু প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে, অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হচ্ছে, অগণিত পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। শুধু নিহত পরিবারগুলো পথে বসছে না, দক্ষ-অদক্ষ ও উদীয়মান মানবসম্পদ ধ্বংসের ফলে জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকা; যা জিডিপির দুই শতাংশ (সূত্র: দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)।

দুই দশকে সড়ক দুর্ঘটনা জাতীয় সংকটে রূপ নেওয়ায় এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও বিশিষ্টজনেরা সোচ্চার হয়েছেন। সবারই এক কথা- সড়ক পরিবহন খাতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার কারণে লাগামহীন দুর্ঘটনা ঘটছে। এ কারণে সরকারসহ সব মহল কয়েকবছর ধরে নড়েচড়ে বসেছে। তারই ধারাবাহিকতায় রোববার (১৭ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনআরসি) ২৬তম বৈঠকে উচ্চপর্যায়ের দুটি কমিটি গঠিত হয়েছে।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ১৫ সদস্যের কমিটি; যেখানে সদস্য আছেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা ও মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ এবং সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী।

সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আপত্তির বিষয়ে ‘বাস্তবসম্মত’ সমাধান খুঁজতে তিন সদস্যের আরেকটি কমিটি হয়েছে; যার নেতৃত্বে আছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সড়ক দুর্ঘটনাবিরোধী স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মুখে গত আগস্টে আইনটি সংসদে পাস হয়।

নতুন আইনের কতিপয় ধারা বাতিলের দাবিতে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন গত অক্টোবরে ৪৮ ঘন্টা ধর্মঘট ডেকে দেশ অচল করে দেয়; যাতে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির প্রকাশ্য সমর্থন ছিল। ২০১১ সালে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার পর গড়ে ওঠা সড়ক দুর্ঘটনাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের বিপক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই মালিক ও শ্রমিক সংগঠন যৌথ সমাবেশ ডেকে তাদের শক্তিমত্তা দেখিয়েছিল।

২০১৭ সালে আদালত বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে আবারো লাগাতর ধর্মঘটের ডাক দেয় মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। এই ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয় তখনকার নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সরকারি বাসায়। এতে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ, এনায়েত উল্যাহ, ওসমান আলীসহ ১৫ সদস্যের কমিটির মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের সবাই উপস্থিত ছিলেন (সূত্র: প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। অথচ তাঁদের ছয়জনকে রাখা হয়েছে শৃঙ্খলা কমিটিতে।

শাহাজান খানের পরিবারের মালিকনায় ঢাকার কয়েকটি পথে কনক পরিবহনের বাস চলে। দূরপাল্লার পথে চলাচলকারী তাঁদের পারিবারিক কোম্পানির নাম সার্বিক পরিবহন। সরকারের মন্ত্রী, পরিবহনমালিক আবার শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ নেতা- এই তিন পরস্পরবিরোধী পদ একাধারে ধারণ করার জন্য বেশ সমালোচনায় পড়তে হয়েছে তাঁকে (সূত্র: প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।

সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাসের পর কয়েকটি দাবিতে মালিক-শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকেছিলেন। তাদের দাবিগুলো হলো- সড়ক দুর্ঘটনার সব মামলা জামিনযোগ্য করা, দুর্ঘটনায় চালকের পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি করা, ৩০২ ধারার মামলার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা, পুলিশি হয়রানি বন্ধ, ওয়েস্কেলে জরিমানা কমানো ও শাস্তি বাতিল এবং গাড়ি নিবন্ধনের সময় শ্রমিক ফেডারেশন প্রতিনিধির প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক করা।

দুর্ঘটনার নামে গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষ খুনের মামলা জামিনযোগ্য হতে পারে না। দুর্ঘটনার দায়ী হলে চালকের জেল-জরিমানা হবে না- এটা অবাস্তব দাবি। বিশেষজ্ঞসহ সড়ক দুর্ঘটনাবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলোর দাবি ছিলো চালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস, সেখানে সরকার অষ্টম শ্রেণি করেছে। এটা পঞ্চম শ্রেণি করার দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ফৌজদারি আইনে ৩০২ ধারার মামলা শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী করতে পারে।

এছাড়া থানায় দায়েরকৃত মামলা তদন্তে বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধি রাখার সুযোগ নেই। নির্ধারিত ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পণ্য বহন করে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত করলে চালককে জরিমানা ও শাস্তি দেয়া যাবে না- এটাও অগ্রহণযোগ্য। গাড়ি নিবন্ধনের সময় শ্রমিক ফেডারেশনের প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক করার অর্থ হচ্ছে এই সংগঠনকে খুশি না করলে কেউ নতুন গাড়ি ক্রয় ও নিবন্ধন করতে পারবেন না। এ যেনো ‘মামাবাড়ির আবদার’। তাই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের এসব দাবি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

এছাড়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ যখন পাস হয় তখন মালিক-শ্রমিক নেতা শাজাহান খান ও মসিউর রহমান রাঙ্গা- দুজনই মন্ত্রী ও সাংসদ ছিলেন (এখনও সাংসদ)। আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার দিন মন্ত্রিসভা বৈঠক এবং সংসদে পাসের দিন অধিবেশনেও উপস্থিত ছিলেন তারা।

আইনটি কণ্ঠভোটে পাসের সময় তারা কেউ ‘না’ ভোট দেননি। অথচ এ দুই সাবেক মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সংগঠনই আইনের কতিপয় ধারা বাতিলের দাবি তুলছে। দুর্ঘটনা রোধে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তাদের নেতৃত্বেই কমিটি করা হয়েছে, তাদের আপত্তির সমাধান খুঁজতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে গণপরিবহন খাতে বিরাজমান নৈরাজ্য; যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি, টার্মিনাল ও স্ট্যান্ডগুলোতে দখলদারীত্বের প্রতিযোগীতা, শ্রমিকদের বেপরোয়া আচরণ, অদক্ষতা ও অসচেনতা, নিয়োগপত্র, প্রয়োজনীয় বেতন-ভাতা ও সাপ্তাহিক ছুটিসহ অন্যান্য সুবিধা না পাওয়ায় সাধারণ শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ, বিআরটিএর জনবল সংকট ও দুর্নীতি, ট্রাফিক আইনসহ সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়া ইত্যাদি। তাই এসব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে সমালোচিত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিয়ে গঠিত কমিটি দুর্ঘটনা হ্রাসে কী ভূমিকা রাখে তা এখন দেখার বিষয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী।
[email protected]

এইচআর/এমকেএইচ