দূরগামী কবির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
নোলক কবিতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার বাবা। তিনি অনেক কবিতা মনের মাঝে গেঁথে রাখতেন। সেগুলো তিনি আবৃত্তি করতেন মাঝেমধ্যে। তাঁর চোখ বেয়ে পানি পড়তো নোলক কবিতা পড়বার সময়। আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে যেতাম তখন। সেসময় থেকে আল মাহমুদ আমার একজন প্রিয় কবি।
আমি সবসময়ই তাঁর কবিতার ভক্ত। আমি একজন সরল সাধারণ কবিতাপ্রেমী মানুষ। বোদ্ধা নই। স্বল্প কাব্যসাহিত্য জ্ঞানে যতটুকু ধারণ করতে পেরেছি তাতেই তিনি গভীরভাবে রেখাপাত করেছেন আমার মনে।
তার রাজনৈতিক স্খলন বা পতন, তার পরিবর্তন বা আদর্শিক বিচ্যুতি নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না আজ। আমি কেবল আমার মনের গহীন থেকে তার কবিতার প্রতি, তার প্রতি আমার ভলোবাসা জানাতে চাই।
কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার তিরিশ দশকীয় প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্য ও নর- নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে অবলম্বন করেছেন।
কবিতার শব্দচয়নে তার অসাধারণ সারল্য আমাকে মোহিত করেছে বার বার। তাঁর 'তিতাস' কবিটির কথা ভাবুন--
"কিছুই খুঁজিনি আমি, যতবার এসেছি এ তীরে
নীরব তৃপ্তির জন্য আনমনে বসে থেকে ঘাসে
নির্মল বাতাস টেনে বহুক্ষণ ভরেছি এ বুক। "
আমি নির্বাক হয়ে তাঁর 'আমার সমস্ত গন্তব্যে' পড়েছি। সেখানে তিনি সারা শহরে তার একজন সুহৃদ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তার আপাত বাস্তবতায় ছিল একটি কড়া নাড়ার আগ্রহ, একটি বন্ধুর মুখ দেখার বাসনা, একটি স্বরচিত কবিতা শোনানোর নির্লজ্জতা। একটি গন্তব্যে তিনি বার বার যেতে চেয়েছেন। তার অভাবের সংসারে তিনি কখনোই রপ্ত করতে পারেননি উপরে ওটার সহজ রাস্তা। একঘরে এ কবি কেবল খুঁজেছেন ভ্রাতৃত্বের রজ্জু।
"আমার একাকী আত্মার পেরেকে বিদ্ধ ছিদ্র পথে
রক্তবমির মতো উগড়ে উঠলো একটি হিব্রূ আর্তনাদ
'এলি, এলি, লামা সবক্তনি।"
(আমার সমস্ত গন্তব্যে)
তার উপমার মাধুর্যে আমি বরাবরই আপ্লুত হয়েছি। কবিতা ছিল তার কাছে কৈশোরের স্মৃতি। ভেসে ওঠা ম্লান মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখি। অদ্ভুত নস্টালজিয়াতে তিনি কবিতাকে তুলনা করতেন পাতার আগুনে ঘিরে রাতজাগা ছোট ভাই বোনদের সাথে। কবিতা তার কাছে ছিল তার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট। কবিতা তার কাছে ছিল গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর।
নিজেকে পলাতক ভাবতেন তিনি কখনো কখনো। তার ক্লান্ত শিশুর শরীর তাকে মনে করিয়ে দিতো পালাবেন কোথায় তিনি। তিনি জীবনের জলাধারে হতে চেয়েছিলেন তুমুল রোহিত। জীবনের পক্ষে তাই সারাদিন দরজা ধরে থাকতেন তিনি। (পলাতক)
তার 'সোনালি কাবিনের' অনিবার্য পংক্তিগুলো চোখে ভাসে, কানে বাজে।
" সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি
.....
বধূবরণ নাম দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বোলো কোননা কবুল, কবুল।"
তাঁর 'মায়াবী পর্দা দুলে উঠেতে' অনেক ভিন্নমাত্রার লেখা আমি পড়েছিলাম। কোনোটা বুঝেছি, কোনোটার কূল কিনারা করতে পারিনি। 'অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না' ছিল অনেক পূর্ণাঙ্গ কবিতার সমারোহে ভরা। 'সজলমুখী' আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি কবিতা :
"নদীর কথা বলা মানেই, বুকে
আস্তে নড়ে জলের ঢেউ ঘোলা,
তোমার নাম ভাবলে ভাসে চোখে
বালিশে লাল গোলাপফুল তোলা।"
আল মাহমুদ কবিতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। অনেক কবিতা অনুবাদ করেছেন, লিখেছেন সনেট। তারপরেও তার মনে কোনো সমাপ্তি জাগেনি। নিজের কবিতা নিয়ে মন্তব্য করার বয়স তার ছিল না কখনোই। খ্যাতি-অখ্যাতির তোয়াক্কা তাকে করতে দেখিনি কখনো। মুক্তিযোধ্যার বড়াই করেননি কোনোদিন। মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জাগতো তার অপূর্ণতার। কখনই তা দেখতে পেতেন না তিনি। আমিও পাইনা।
তিনি প্রচলিত বাংলাভাষার কাঠামোর মাঝে স্বতঃস্ফূর্ত আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন খুব সহজে। আমার মতে জীবনানন্দ এবং জসীমউদ্দীনের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ধারা তৈরি করেছিলেন তিনি। সব সময়ই তিনি ছিলেন প্রহরান্তের পাশফেরা মানুষ।
'নিজের দিকে' তাকিয়ে তাই একদিন লিখেছিলেন তিনি :
" আসলে তো আত্মাই সব
ঘুরে ফিরে কোনো গতি নেই,
একদিন ফিরে যেতে হয়
অবশেষে নিজের দিকেই। "
শেষ বিদায় জানাই আমার লোক-লোকান্তরের কবিকে। অবশেষে পরিসমাপ্তির বিশ্রামে পৌঁছে গেছেন তিনি। দূরগামী প্রিয় কবির জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এসএইচএস/এমএস