বাকি জাহালমদের কী হবে?
আর দুটা দিন ভুগলে নিরীহ শ্রমিক জাহালমের কারাভোগের তিন বছর হতো। তার গ্রেপ্তারের পর থেকে বড় ভাই দরিদ্র শাহানূর দিনের পর দিন ঘুরেছেন আদালত থেকে কারাগার, কারাগার থেকে আদালতে। রবিবার দুপুরে জাহালমকে হাইকোর্ট মুক্তির নির্দেশ দিয়েছে খবরটি শুনে শাহানূর ছুটে যান কাশিমপুর কারাগারে।
বিকাল গড়িয়ে রাত বাড়ার সঙ্গে শীতে কাঁপতে থাকেন শাহানূর। এক হাজার ৯২ দিন পর রবিবার মধ্যরাতে কাশিমপুর কারাগার থেকে বের হওয়ার পর জাহালমকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভাই শাহানূর। ভাইকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর যেন ঈদ নামে তাদের ঘরে। মা তাকে দুধ-গোসল করিয়ে শনির আছরমুক্ত করে ঘরে তোলেন।
জেলগেটে সাংবাদিকদের জাহালম তার বিনা দোষে জেল খাটার জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। দাবি করেন ক্ষতিপূরণ। টাঙ্গাইল নাগরপুরের জাহালমরা তিন ভাই, তিন বোন। জাহালম নরসিংদীর একটি জুটমিলের শ্রমিক। সবার বড় শাহানূর ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। আর মানুষের কাছে তাদের মা মনোয়ারার পরিচয় ‘কাজের বুয়া’।
অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলে-মেয়েকে বড় করেছেন তিনি। ৩০টি বছর পরের বাড়িতে জন্ম, বেড়ে ওঠার পর বছর কয়েক আগে ধারদেনা করে ১০ শতাংশ জায়গা কেনে পরিবারটি। সেখানে তারা তুলেছে টিনের দোচালা দুটি ঘর। এই ঘরের জাহালমকেই সাজানো হয়েছে জালিয়াত। তা-ও এক-দুটি নয়। একে একে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলায় নিরপরাধ জাহালমকে জেলখাটানো হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবু সালেকের (মূল অপরাধী) বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন, আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন জাহালম। তাকে গ্রেফতার করা হয় ২০১৬ সালের ৬ জুন নরসিংদী থেকে। ওই বছরের ২৭ মে স্থানান্তর করা হয় কাশিমপুর কারাগারে। মামলা চালাতে গিয়ে প্রচুর ধার-দেনা করেছেন। সুদে টাকা এনেছেন। নিয়েছেন এনজিওর ঋণও। পাওনাদারদের চাপে একজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে আরেকজনকে দেন।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর পুলিশ, দুদক, আদালতের কাছে মাথা ঠুকে জাহালম বলেছেন, সে সালেক নয়, জাহালম। এসবের কিছুই জানে না সে। তার ভাই শাহানূর দুদকের কর্মকর্তাদের বারবার বলেছেন, তার ভাই নিরপরাধ। কিন্তু কেউ তার কথা আমল দেননি। শুনতেই চাননি। তিনি সুদের টাকা নিয়ে ভাইকে মুক্ত করতে উকিল ভাড়া করেন। নিয়োগ দিয়েছিলেন আইনজীবী। কিন্তু ফল মেলেনি।
নিরুপায় জাহালমের ভাই শাহানূর গত বছর যান মানবাধিকার কমিশনে। শাহানূরের অভিযোগ পেয়ে মানবাধিকার কমিশনার কাজী রিয়াজুল হক ছুটে আসেন কাশিমপুর কারাগারে। কথা বলেন জাহালমের সঙ্গে। তিনি নিশ্চিত হন, জাহালম তাঁতকলশ্রমিক। বাংলায় কোনোমতে স্বাক্ষর করতে জানেন। ব্যাংক জালিয়াতি মামলার আসামি সাগর আহম্মেদ তাকে জানান, আসল আসামি সালেককে তিনি চেনেন।
মানবাধিকার কমিশন তখন আসামি সালেকের জীবনবৃত্তান্ত জানতে চেয়ে ঠাকুরগাঁও স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি লেখে। কারাগারে থাকা জাহালমের জীবনবৃত্তান্ত জানতে চেয়ে চিঠি দেয় টাঙ্গাইলের নাগরপুরের প্রশাসনকেও। স্থানীয় প্রশাসনের পাঠানো প্রতিবেদনে মানবাধিকার কমিশন নিশ্চিত হয়, ব্যাংকের টাকা জালিয়াতের কিছুই জানে না জাহালম। এ চক্রের মূল হোতা সালেক মোজেই দিন কাটাচ্ছে। তার সম্পদ বেড়েছে। কিনেছে জমি-জিরাতও।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান চিঠি দেন দুদককেও। কথা বলেন দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে। দুদকের তদন্তে উঠে আসে, জাহালম নিরপরাধ। এরমধ্যেই ৩০ জানুয়ারি গণমাধ্যমে আসে চাঞ্চল্যকর খবরটি। সেদিনই বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত।
শুনানি নিয়ে আদালত জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি হয়। একই সঙ্গে নিরীহ জাহালমের গ্রেপ্তারের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্রসচিবের প্রতিনিধি ও আইনসচিবের প্রতিনিধিকে ৩ ফেব্রুয়ারি সশরীরে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত), মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্রসচিবের (সুরক্ষা) প্রতিনিধি যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং আইনসচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম আদালতে হাজির হন। আদালত সবাইকে কম-বেশি ভর্সৎনা করেছে। আর দেয়া হয়েছে জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ। এর মধ্য দিয়ে অবসান হয় বিনা দোষে জাহালমের জেলখাটার করুণ অধ্যায়ের।
আদালতের আদেশে দেশবাসী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে সত্য। কিন্তু কতো জাহালম ও জাহালমদের পরিবার উপার্জনক্ষম মানুষটাকে হারিয়ে নিঃস্ব- রিক্ত- সর্বস্বান্ত হয়ে হাহাকার করছে? সব ভেজাল কি দুদকই করেছে? দুদক ছাড়াও জাহালমের মাথা ঠোকানো পুলিশ কর্মকর্তা বা প্রতিষ্ঠানকে কি জবাবদিহি করতে হবে না? দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে ওই কর্তারা সমাজে সম্মানিত হতেই থাকবেন।
আর তাদের কুকীর্তির শিকার নিরপরাধদের জীবন ধ্বংসই হতে থাকবে। জাহালমের মতো বন্দির সংখ্যা নিয়ে নেই সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এ নিয়ে কোনো সংগঠন বিশেষভাবে কাজ করছে বলেও জানা নেই। তবে, এ সংক্রান্ত তথ্য-সাবুদের অন্যতম যথাযথ ব্যক্তি মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল ভাসা ভাসা কিছু তথ্য দিয়েছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ উপদেষ্টার দাবি: দেশের জেলখানাগুলোতে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বিনা বিচারে আটক রয়েছে। তাদের মধ্যে বড় সংখ্যক মানুষ কোনো অপরাধ না করেই বন্দিখানায় দিন কাটাচ্ছে।
কোন সূত্রের আলোকে সুলতানা কামালের এ তথ্য তা স্পষ্ট নয়। তবে, এ কথা বলাই যায়- জাহালমের সংখ্যা অগুণতি। তথ্যটি অবশ্যই উদ্বেগজনক। জাহালমের মতো বাকিদের নিয়ে গণমাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে রিপোর্ট হয়নি। জাহালমের বিষয়টিও এতোদূর গড়াতো না গণমাধ্যমে খবর প্রচার না হলে। যথারীতি চলতে থাকতো তার বন্দিজীবন। কারা ভুগতেন তিনি নিজে। আর যন্ত্রণা সইতে থাকতো তার স্বজনরা। গণমাধ্যমের পক্ষে ক’জন জাহালমকে খুঁজে এমন রিপোর্ট করা সম্ভব? মানবাধিকার কমিশন ক’টির হিল্লা করবে? আদালতই বা স্বেচ্ছাপ্রণোদনে কতো নির্দেশনা দেবে? এটা কাহাতক সম্ভব?
আইনের আশ্রয় পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। অর্থ, ক্ষমতা, বিত্ত, রাজনৈতিক সংযোগশালী না হলে আইনের আশ্রয় দূরের কথা, উল্টো অন্যের মামলায় নিজের জেল খাটতে হতে পারে। কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে ‘গাফিলতি’ শব্দটি টেরে আনছেন। গাফিলতি বলতে মনে করা হয় অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি। কিন্তু জাহালমের ব্যাপারটা কি অনিচ্ছাকৃত ছিল?
গাফিলতি বলে অপরাধকে হালকা করে দেখিয়ে শুধু ক্ষমা প্রার্থনা আর দুঃখ প্রকাশ করে পার পাওয়ার সুযোগ কব্জা হয়। সমাজ-সংসারে ভুল বেশি হয় গরিবের সঙ্গে। ধনীদের সাথে ভুল হয় না। হলেও সেটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। দুদক কর্মকর্তাদের '৩৩টি' মামলার মধ্যে '২৬টিতে' জাহালমকে মূল আসামি আবু সালেক হিসিবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয়াটা কোনোভাবেই গাফিলতি হতে পারে না।
এর পেছনে পরিকল্পনার সন্দেহ ও আলামত ব্যাপক। সালেহের কোটি টাকার ভাগ নিয়ে কর্মকর্তারা সালেহের পরিবর্তে জাহালমের উপরই জুলুম করেছেন কি-না খতিয়ে দেখা দরকার। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বিভিন্ন ব্যাংক লুট, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকসহ অন্যান্য দুর্নীতি-লোপাটকারীদের ধরতে দুদকের এমন তৎপরতা কি দেখা গেছে? আদালতের মন্তব্যেও এর কিছু ইঙ্গিত রয়েছে। আদালত জাহালমকে বিনা দোষে জেল খাটানোকে তুলনা করেছে আরেকটি জজ মিয়া নাটকের সঙ্গে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম