ধর্ষণ ও হারকিউলিস
না গ্রিক পুরাণের মহাবীর হারকিউলিস নিশ্চয়ই নন, কিন্তু এই নামেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতেই আলোচিত হচ্ছে হারকিউলিস নামটি। ঘটনা প্রায় সকলেরই জানা। তারপরও যারা জানেন না তাদের জন্য সংক্ষেপে বলছি।
সম্প্রতি এক মাদ্রাসা ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষকরা তাদের অপরাধের ভিডিও চিত্রও মোবাইলে ধারণ করে। এই ঘটনায় দুজন আসামীর নাম আসে। সেই দুজন আসামীকেই মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাদের হত্যা করা হয়েছে। মৃতদেহের গলায় ঝুলানো ছিল একটি চিরকুট। সেখানে বলা হয়েছে ধর্ষকের এটাই প্রাপ্য।
প্রথম মৃতদেহের সঙ্গে হত্যাকারী নিজের পরিচয় দেয়নি। দ্বিতীয় ধর্ষকের মৃতদেহের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটে হত্যাকারী নিজের নাম হারকিউলিস বলে উল্লেখ করেছে। অন্য ধর্ষকদেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এই সংবাদটি যখন আমি পত্রিকায় পড়ি তখন প্রথমেই যে প্রতিক্রিয়া আমার মনে এসেছিল সেটা হলো উচিত শিক্ষা হয়েছে। যেমন কুকুর তেমন মুগুর। ধর্ষকদের মেরে ফেলাই দরকার। কারণ প্রতিদিন গণমাধ্যমে নারী ও শিশু ধর্ষণের সংবাদ পড়তে পড়তে তীব্র ক্ষোভ মনে বাসা বাঁধছে।
একের পর এক শিশু ও নারী ধর্ষণের শিকারে পরিণত হচ্ছে। তাদের অনেককেই হত্যাও করা হয়েছে। নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য শিশুও রেহাই পাচ্ছে না নরপশু ধর্ষক ও খুনিদের হিংস্র থাবা থেকে। এমন অবস্থায় যদি রাগে ক্ষোভে কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে ধর্ষক হত্যায় এগিয়ে আসে তাহলে সেই ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় বিনা বিচারে হত্যা কখনও সমর্থনযোগ্য নয় এবং এটা অপরাধের সমাধানও নয়।
এটি হলো এক অপরাধের বদলে আরেক অপরাধের জন্ম দেওয়া। এবং মানুষ যখন রাষ্ট্রীয় বিচারের প্রতি আস্থা হারায়, যখন সরকারি প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারায়, যখন দেশে অরাজকতা বিরাজ করে তখনই নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার অপরাধগুলো সংঘটিত হতে থাকে। কিন্তু প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের প্রতি কেন এই আস্থাহীনতা? আস্থাহীনতা এই কারণে যে, বাংলাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণ ও হত্যা রীতিমতো মহামারী আকার ধারণ করেছে।
বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, আইনের ফাঁকফোকর গলে অপরাধীদের রেহাই পাওয়া, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান অপরাধীদের ভিকটিমকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবহেলা খুবই দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যে হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক বেশি আলোড়ন উঠেছিল সেই নীহার বানু হত্যাকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং শহীদ পিতার সন্তান নীহার বানুকে ১৯৭৬ সালের ২৭ জানুয়ারি হত্যা করা হয়। সহপাঠী আহমদ হাসান বাবু নীহারবানুকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু নীহার রাজি ছিলেন না। আহমদ হাসান বাবু ও তার বন্ধুরা মিলে নীহারকে অপহরণ করে। নির্মম নির্যাতনের পর নীহারকে হত্যা করে মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে রাখা হয়।
এই মামলায় মূল আসামি বাবুসহ তিনজনের ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু একজনের ফাঁসি হলেও প্রধান আসামি বাবু এবং অন্য একজন এখনও পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ড কার্যকর করা যায়নি। (নীহার বানু হত্যাকাণ্ডের খুঁটিনাটি তথ্য জানালেন সিনিয়র সাংবাদিক ও এই মামলার আলোচিত প্রতিবেদক আহমেদ শফিউদ্দিন।) যখন কোন অপরাধী শাস্তি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয় তখন অন্য আরও অপরাধীর জন্ম হয়। কারণ তারা ভাবে অপরাধ করে রেহাই পাওয়া তো সম্ভব।
বাংলাদেশে আরও অসংখ্য ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামী ধরা পড়েনি, দণ্ড কার্যকর হয়নি অথবা মামলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে মাঝপথে। ২০১৬ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসের ভিতর ধর্ষণ ও হত্যা করা হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে। তিন বছর হয়ে গেলেও অপরাধীরা ধরা পড়েনি। বিচার তো দূরের কথা।
২০১৬ সালে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রিশাকে ওবায়দুল হক নামে এক বখাটে দিনে দুপুরে স্কুলের সামনের ওভারব্রিজে ছুরি দিয়ে হত্যা করে। এখনও পর্যন্ত সেই মামলা ঝুলে আছে। বিচার হয়নি আরও শত সহস্র ধর্ষণ ও হত্যা মামলার। যদি প্রতিটি খুনি ও ধর্ষক ও উত্ত্যক্তকারীর দ্রুত বিচারের আওতায় বিচার হতো, শাস্তি হতো, দণ্ড কার্যকর হতো তাহলে এমন ধর্ষকের লীলাভূমিতে পরিণত হতে পারত না প্রিয় স্বদেশভূমি।
নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় যদি আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্য জিরো টলারেন্স মনোভাব নিয়ে তৎপর হতেন তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। গত ৩৩ দিনে পত্রিকায় ৮১টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার খবর প্রকাশিত হয়েছে। একটি দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতির কতটা অবনতি হলে এই পরিস্থিতি হয়! সেই কারণেই জন্ম হয় তথাকথিত হারকিউলিসদের। ধর্ষকদের শায়েস্তা করতে সরকারি পুলিশ বাহিনী কি তাহলে যথেষ্ট নয়?
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া এবং বিনাবিচারে হত্যা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এর ফল ভয়াবহভাবে অশুভ। এতে নৈরাজ্যের পথ প্রশস্ত হয়। মানুষের মানবিক অধিকারগুলো হুমকির মুখে পড়ে। এই অবস্থা প্রতিরোধে প্রয়োজন দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এবং তা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা।
এদেশ থেকে ধর্ষণ নামক অপরাধটিকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলতে হবে এবং প্রতিটি ধর্ষণ ও হত্যার দ্রুত বিচার ও অপরাধীদের কঠোরস্য কঠোর দণ্ড বিধান করতে হবে। দণ্ড দ্রুত বাস্তবায়নও করতে হবে। ধর্ষণ মামলার পলাতক আসামীদেরও দ্রুত গ্রেপ্তারের পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে ভয়াবহ ভবিষ্যত এড়ানো সম্ভব হবে না কোনভাবেই।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/এমকেএইচ