ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু ও ৭১’র চেতনা অনস্বীকার্য

আশীষ কুমার দে | প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

বাংলাসাহিত্যের নবজাগরণে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও অমৃতাক্ষর ছন্দের জনক হিসেবে খ্যাত ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার মধুসূদন দত্ত (খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের পর মাইকেল মধুসূদন দত্ত) ইংরেজি, ফারসী ও আরবী ভাষায়ও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত-ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি সন্তান যৌবনে পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন।

কিন্তু যতোদিন না তিনি মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চ্চা শুরু করেছিলেন, ততোদিন তাঁর স্বীকৃতি মেলেনি। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কোনো ভালো অর্জন সম্ভব নয়; শেকড়কে অস্বীকার করে স্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তাই অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মাতৃভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি এবং কৃতিত্বগুণে কবি থেকে মহাকবি বনে যান; দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খ্যাতি।

আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি ও ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স (এনডিএ); যার প্রধান শরিক ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই দলেরই একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ জাতীয় কংগ্রেস। বলা যায়, রাজনীতিতে দুটি দলের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখছি, দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুদিনে নরেন্দ্র মোদি তাঁর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। অথচ ইন্দিরা হলেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর ঠাকুরমা (দাদী) এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভাপতি রাজিব গান্ধীর মা।

এর সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র বাংলাদেশে। প্রয়াত কোনো জাতীয় নেতার মৃত্যুদিনে বিপরীত স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলোকে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায় না। এমনকি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসেও (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ দিবস) বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ বড় দলগুলো কোনো কর্মসূচি পালন করে না, টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর সমাধি কিংবা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘরে যায় না, গণমাধ্যমে বিৃবতি দিয়েও শ্রদ্ধা জানায় না। উপরন্তু ইতিহাসের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের শোকাবহ এ দিনে কেক কেটে ‘ভুয়া জন্মদিন’ পালন করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। যদিও দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাবন্দি থাকায় গত ১৫ আগস্ট বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিতে পারেননি তিনি।

বঙ্গবন্ধুর পরিচয় শুধু বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কিংবা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নয়; তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। একটি জাতিকে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে উজ্জীবিত করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করেছেন, বাংলার সবুজপ্রান্তরে উড়িয়েছেন বিজয় কেতন। তিনি কালের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

বঙ্গবন্ধুকে হিমালয় পর্বতমালার সঙ্গে তুলনা করে কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট লৌহমানবখ্যাত ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি।” এই একটিমাত্র উক্তি দিয়েই উপলব্ধি করা যায়, বঙ্গবন্ধু কতো বড়মাপের নেতা ছিলেন; বিশ্বে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কতোটা উচ্চে উঠেছিল। আর বাঙালির হৃদয়ের চূড়ামণিতে বঙ্গবন্ধু যে স্থান করে নিয়েছেন, তা চির অটুট থাকবে। তাই স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেও জনগণের মন থেকে তাঁকে মুছে ফেলতে পারেনি; পারবেও না কোনোদিন।

একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম নয়। একাত্তরের চেতনার শেকড় অনেক গভীরে বিস্তৃত। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে গেলেও বাঙালিসহ বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ববাংলা) জনগণের মুক্তি মেলেনি।

ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশদের কূটচালে বিজাতীয় বিদ্বেষের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল এবং জনগণ পেয়েছিল শুধুমাত্র ভৌগলিক স্বাধীনতা। এ দেশের মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-বৈষম্য, জুলুম-নির্যাতন, ভাষাগত ও সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন অব্যাহতই ছিল না, বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।

১৯৫২’র সফল ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাঙালির বিজয়, ৬২’র হামদুর কমিশন শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাফল্য, ১৯৬৪’র হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে লেলিয়ে দিয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের তীব্র প্রতিবাদ, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে ৬৯’র সফল গণআন্দোলন, ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানিদের ভরাডুবি- এসবই ছিল শোষণ-বঞ্চনা, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের পুঞ্জিভুত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

দীর্ঘ ২৪ বছরে (১৯৪৭-১৯৭১) এতোসব ঘটনার মধ্যদিয়ে বাঙালির মনে মুক্তির তীব্র আকাঙ্খা জাগ্রত হয়েছিল। উল্লেখিত রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলো এবং সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষসহ আপামর জনতা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রহর গুণছিল। ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও পাকিস্তানিরা যখন বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা টালবাহানার আশ্রয় নিতে থাকে, নিরীহ বাঙালিদের ওপর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে, তখন চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এ দেশের জনগণ।

এমনই এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। এর জবাবে পাকিস্তান সরকার বাঙালি সেনাসদস্যদের পাশ কাটিয়ে পাকিস্তান থেকে অবাঙালি সেনাসদস্যদের আনতে শুরু করে। এতে বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠে আপামর জনতা। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পাঁয়তারাও চালাতে থাকে সরকার। বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বাংলার জনগণকে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ; যার চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর।

সুতরাং ‘বঙ্গবন্ধু ও একাত্তরের চেতনা’ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভিন্ন সত্ত্বা, রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঐতিহাসিক এ সত্যকে মেনে নেওয়া না হলে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে অস্বীকার করা হবে, অবমাননা করা হবে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ বীরাঙ্গনা মা-বোনসহ অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে; যা কার্যত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকেই অস্বীকার করার সামিল।

তাই যারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্বীকার করে না, তারা জনবিচ্ছিন্ন হতে হতে একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। অন্যদিকে যারা ক্ষমতার লোভে সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করে, একাত্তরের চেতনার কথা বলে মুখে ফেনা তোলে অথচ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের বিপক্ষে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতিকে লালন করে- তাদেরও একই পরিণতি হবে। এটাই হবে ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা।

তাই সকল দলের উচিত যার যার অবস্থানে থেকে বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে গঠনমূলক রাজনীতি করা, সাধারণ মানুষের চাহিদা ও আকাঙ্খাকে প্রাধান্য দিয়ে সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা। তাহলেই কেবল শোষণ-বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র তথা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন