ডাকসু নির্বাচন : খুলছে নেতা তৈরির পাইপলাইন
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শেষ হয়নি এখনও। এরমধ্যেই নির্বাচন কমিশন আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে উপনির্বাচন এবং কিশোরগঞ্জ-১ আসনে পুনঃনির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।
এ দুটি নির্বাচনই হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। আর মার্চ মাসে নির্বাচন কমিশন ব্যস্ত থাকবে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে। তবে এই ডামাডোলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের তারিখও ঘোষিত হয়েছে। আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ- ডাকসু নির্বাচন। এটিকেই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বলছি, কারণ মান যেমনই হোক নির্দিষ্ট সময় পরপর জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ডাকসুতে ২৯ বছরের জট।
সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৬ জুন, স্বৈরাচারের আমলে। মজাটা হলো স্বৈরাচার এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে ৩ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু তার পতনের পর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরুর ২৯ বছরে একবারও হয়নি। এমনিতে প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। সে হিসেবে ২৯ বছরে ২৯টি ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা।
আমি যদি সাধারণ হিসাব আমলে না নিয়ে স্বৈরাচারের হিসাবও ধরি, তাহলেও তো অন্তত ১০টি নির্বাচন হতে পারতো। কিন্তু ২৯ বছরে বুড়িগঙ্গায় পানি গড়াতে গড়াতে ঘোলা হয়ে গেছে, অপরাজেয় বাংলাও পরাজিত হয়েছে ডাকসুর বন্ধ্যাত্বে। কিন্তু নির্বাচন আর হয়নি।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে এই ২৯ বছরে অনেক কথা হয়েছে, অনেক জল ঘোলা হয়েছে। একাধিকবার উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি নিজে 'ডাকসু নির্বাচন ইজ অ্যা মাস্ট' বলেছেন। নির্বাচনের দাবিতে এক ছাত্র অনশন করেছেন। কিন্তু কিছুতেই টনক নড়েনি কারো।
শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সবকিছু নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আসলে শেষ কথা বলা যাবে না। কারণ তারিখ ঘোষণার পরও ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার কথাও আমরা জানি। চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়েছে, এখন দই দেখলেও ভয় লাগে।
ডাকসু নির্বাচন বন্ধ, তাই বন্ধ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনও। আমি বলি, বন্ধ নেতা তৈরির পাইপলাইনও। গত ২৯ বছরে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে অনেক কথা হয়েছে। এমনকি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রও হয়েছে বারবার। সব ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে ভালো জবাব যেটা, নির্বাচন, সেটাই হয়নি।
ছাত্র রাজনীতি থেকে ধাপে ধাপে উঠে জাতীয় নেতৃত্বে এলে, সেই নেতা অনেক বেশি ভালো নেতা হন। ডাকসুর আগের নেতারা এখনও আমাদের রাজনীতির উজ্জ্বল অধ্যায়। যারা ছাত্র রাজনীতি থেকে এসেছেন তারাও নেতৃত্ব দিচ্ছেন সামনের কাতার থেকে। একবার ভাবুন, গত ২৯ বছরে যদি ১০টি ডাকসু নির্বাচনও হতো, অন্তত ১০ জন ভিপি, ১০ জন জিএস পেতাম আমরা।
তবে ১০/২০ জন নেতা বানানোর জন্যই যে ডাকসু নির্বাচন দরকার, তা নয়। শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান, তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ, নেতৃত্ব বেছে নেয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যও ডাকসু নির্বাচন দরকার। সব শাসকরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে ভয় পায়।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, এমনকি ওয়ান ইলাভেনের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটা উঠেছিল এই ক্যাম্পাস থেকেই। তাই সব সরকারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
ডাকসু নির্বাচন দিয়ে ছাত্রসমাজকে দাবি আদায়ে সচেতন হতে দিতে চায় না। কিন্তু একটা জিনিস সবার বোঝা দরকার, ন্যায্য দাবি কখনো চাপা দিয়ে রাখা যায় না। কোনো না কোনোভাবে আন্দোলন গড়ে ওঠে। সর্বশেষ কোটা আন্দোলন তার প্রমাণ। আর জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনেও ডাকসু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তবে ডাকসু নির্বাচনের আগে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
গত ২৯ বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্র রাজনীতি নির্বাসিত। এখন সেখানে বিরোধী মতের কোনো স্থান নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ সর্বেসর্বা, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল; এটাই যেন ক্যাম্পাসের রীতি। অথচ স্বৈরাচার আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মতের স্থান ছিল। তখন ভাগাভাগিটা এমন ছিল- উত্তর পাড়া মানে মহসিন, সূর্যসেন, জসীমউদদীন, বঙ্গবন্ধু, জিয়া হল ছাত্রদলের দখলে আর দক্ষিণপাড়া মানে জহুরুল হক, এস এম, জগন্নাথ, শহীদুল্লাহ হল ছিল ছাত্রলীগের ঘাঁটি। এখন আর কোনো ভারসাম্য নেই।
নির্বাচনের আগে তাই ক্যাম্পাসে সব সংগঠনের বৈধ ছাত্রদের অবস্থান ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন এবার হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্খাপনের দাবি জানিয়েছে। তবে হলে সহাবস্থান নিশ্চিত করা গেলে ভোট কেন্দ্র কোথায় হবে, তাতে কিছুই যায় আসে না। আবার সহাবস্থান না থাকলেও ভোটকেন্দ্র কোথায় হবে, তাতে কিছু যায় আসে না। তাই কেন্দ্র হলের বাইরে করার চেয়ে সহাবস্থান নিশ্চিত করাটা জরুরি।
২৯ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। ডাকসুর পথ ধরে নিশ্চয়ই অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে। আমরা চাই ডাকসু নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ হোক; যাতে ছাত্ররা তাদের সত্যিকার প্রতিনিধি বেছে নেয়ার সুযোগ পায়।
এইচআর/এমএস