ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ঘর হারানো লিলি এবং শিশু পর্নগ্রাফি

নাসরীন মুস্তাফা | প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

ঘর নেই লিলি’র।
লিলি ভাবে, খেলা শেষে সবাই বাড়ি ফিরবে। আমার কোন বাড়ি নেই। আমি কোথায় যাব?
তখন লিলির মুখটা ঝুঁকে যায় নিচে। খুব মন খারাপ যে, তা ওর চোখ দেখলেই বোঝা যায়। ঘর না থাকলে মন তো খারাপ হবেই।

লিলি সিসেমি স্ট্রিটের নতুন চরিত্র। ছোট বাচ্চাদের মনের উপর কতটা চাপ পড়ে, যখন সে ঘরহীন হয়ে যায়, তা বোঝানোর জন্যই লিলির আসা।

শিশুদের টিভি শো তৈরি করে অলাভজনক শিক্ষামূলক সংস্থা সিসেমি ওয়ার্কশপ। আমেরিকাতেই ঘরহীন শিশুর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। আর এই সমস্যাকে নিজেদের মতো করে সামলানোর জন্যই লিলি।

লিলির পুরো বৃত্তান্ত আগে জেনে নেই। সাত বছরের ছোট্ট লিলি আর ওর পরিবার বাস করে সিসেমি স্ট্রিটে। ঘরবাড়ি হারিয়ে ফেলে এখানেই ঠাঁই নিয়েছে। ওকে নিয়ে দুই থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের জন্য সিসেমি ওয়ার্কশপ নতুন নতুন ভিডিও, টিভি শো, গল্পের বই আর নানা রকম অ্যাকটিভিটি তৈরি করেছে।

টিভি শো’র এক পর্বে লিলি খুব মন খারাপ করে। কেননা, খেলার পর সব বন্ধুরা যার যার বাড়ি চলে যাবে। অথচ লিলির নিজের বাড়ি নেই। ও বলে, ‘কখনো কখনো মনে হয়, আমি যদি আবার আমার ঘরটা পেতাম!’
ফেলে আসা ঘরের জন্য মন খারাপ লিলির।

আরেকটা পর্বে লিলিকে মনে করতে হয়, ওর ফেলে আসা বাড়িতে কি কি ছিল। বেগুনি রঙ দেখে ওর মনে করার খেলায় মনে পড়ে, ফেলে আসা প্রিয় শোবার ঘরটার দেয়ালে ঠিক এই রঙটাই ছিল। লিলি নানা কাজে মনে করিয়ে দেয়, ঘর মানে আসলে কি। যারা ওকে ভালবাসে, তারা সবাই ওর সাথে ওর ঘরে ছিল। এর মানে, ঘরে থাকে ভালবাসার মানুষরা। এই ঘর স্থায়ী হতে হবে, তেমন কোন কথা নেই। তবে, ভালবাসার মানুষ ছাড়া ঘর থাকে না। মানুষগুলো হারিয়ে গেলে ঘর বাঁচে না।

ডললির আপনজনরা হারিয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি শিশু ঘরছাড়া হয়ে পড়েছে। আপনজনদের হারিয়ে ফেলছে। কয়েক বছর ধরেই আমেরিকাতে বাস করতে চাওয়া লাখো অভিবাসীর কাছ থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়া হয়। কয়েক দিন এ নিয়ে সবাই খুব কথা বলেছে। শিশুদেরকে আপনজন ছাড়া করার এই বাজে কাজটার জন্য আমেরিকার সরকারকে সবাই বকা দিয়েছে।

লিলি আমেরিকার সীমান্তে বিপদে পড়ে যাওয়া সেই শিশুদের মতোই একজন। যদিও এই রকম শিশুদের খোঁজ পাওয়া যাবে বিশ্বের আরও অনেক জায়গায়। রোহিঙ্গা শিশুরাও অনেকে ঘরছাড়া হয়ে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সিরিয়ান শিশু, ইয়েমেনের শিশুদেরও অবস্থা এক-ই। এই শিশুদের চোখের ভাষা একই। ওরাও লিলির মতো মন খারাপ করে। কথা বলার সময় চোখ ভরে ওঠে পানিতে। মুখ নিচু হয়ে যায়। বুক থেকে বেরিয়ে আসে অনেক দীর্ঘশ্বাস।

লিলির মন ভাল করার জন্য ওর বন্ধুরা কি কিছুই করবে না? সিসেমি স্ট্রিটে লিলির বন্ধুরা করে অনেক কিছুই। লিলি এবং ওর বন্ধুরা মিলে যারা ওদেরকে দেখছে, সেই সব দর্শক শিশুদেরকে আশার কথা শোনায়। ওরা ইতিবাচক সাহস জোগায়। ঘরহীন শিশুর সাথে বন্ধুত্ব করা যায়, এটা বোঝায়। এই শিশুদের মনোভাব বুঝতে সাহায্য করে। ঘরহীন পরিবেশে শিশুরা কীভাবে টিকে থাকতে পারে, তার নানা কৌশলও শিখে নেয়।

সিসেমি স্ট্রিটের বিশ্বব্যাপী প্রভাব আর মানবতা বিভাগের প্রেসিডেন্ট শেরি ওয়েস্টিন বললেন, ‘আমরা জানি ঘরহীন শিশুর অভিজ্ঞতা খুব ভয়ানক। ঘর নেই, এই চিন্তা ওদের মাঝে আতংক তৈরি করে, যা ধ্বংসাত্মক। ঘর হারিয়ে ফেলার কারণে তৈরি হওয়া দারিদ্র্য, পারিবারিক সহিংসতা আর এরকম আরও মানসিক দুঃশ্চিন্তা থাকেই। এর পাশাপাশি যোগ হয় ঘর হারিয়ে ফেলার পর অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তার অভাবজনিত মানসিক চাপ।’

বিশ্বজুড়ে একশ মিলিয়ন শিশু ঘরহীন। ইউনিসেফের হিসেবে, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে প্রতি বছর আটাশ মিলিয়ন শিশু ঘর হারাচ্ছে, আপনজন হারাচ্ছে। ইউনিসেফ দেখেছে, প্রায় এই রকম সংখ্যক শিশু ঘর হারাচ্ছে, কেননা তাদের পরিবার আরও ভাল থাকার আশায় ঘর ফেলে রেখে পথে নামে। স্বপ্নের দেশে বাস করতে চেয়ে শরণার্থী হয় তারা।

স্বপ্নের দেশ আমেরিকাতেই প্রতি বছর আড়াই মিলিয়ন শিশু পথশিশু হচ্ছে। আমেরিকার প্রতি ত্রিশটি শিশুর একজন পথশিশু হতে বাধ্য হয়, যা আমেরিকান ইতিহাসের সর্বোচ্চ হিসাব। এই শিশুদের গড় বয়স নয় বছর। এরা বাস করে পথে পথে। এরা স্কুলে যায় না। শিক্ষার কোন সুযোগ পায় না। এরা কেউ চকচকে রঙিন গল্পের বই দেখেনি। প্রতি দিন নানা অসুখ আর অপুষ্টিজনিত কারণে এরা পথেই মারা যায়। যারা বেঁচে থাকে, তারা অপরাধ করা শেখে।

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-মাদক ব্যবসায় জড়ায়। হয়ে ওঠে সন্তাসী-জঙ্গি-মাদকাসক্ত। এই শিশুদের প্রায় দুই মিলিয়ন ফাঁদে পড়ে যায় যৌন নিগ্রহের, তাদের বেশির ভাগ অবশ্য মেয়েশিশু। শিশুদেরকে কেন এই কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, জানেন? বিশ্ব জুড়েই শিশু পর্নগ্রাফি আর শিশুদেরকে যৌনকর্মী বানানোর ব্যবসা দিনকে দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে যে!

লেখক : শিশুসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন