ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ধন্যবাদ বাংলার তারুণ্য

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল | প্রকাশিত: ০৯:৫২ এএম, ১৭ জানুয়ারি ২০১৯

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, স্বাধীনতার সপক্ষের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নির্মূল কমিটির দেশব্যাপী যে আরো একটি অভিযাত্রা আর শতাধিক জন কিংবা পথসভার যে বিশাল কর্মযজ্ঞ তার সূচনাটা হয়েছিল গত বছরের মাঝামাঝি ঢাকায় একটি প্রতিনিধি সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে। যাদের আদর্শ জেনে এই আন্দোলনে সহযাত্রী ছিলাম, তাদের এই সমাবেশের একটি পর্বে সভাপতিমণ্ডলীতে সহসা অন্তর্ভুক্তি আমার কাছে মনে হচ্ছিল এ যাবৎ পাওয়া দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল ভাইয়ের আমন্ত্রণে মঞ্চে আসন ছেড়ে ধীর পায়ে যখন পোডিয়ামের দিকে এগুচ্ছি, কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন আমি। মাত্রই পূর্ণিমা বলে গেল ২০০১-এর নির্বাচন পরবর্তী তার দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা। সামনে আরেকটি নির্বাচন আর আমাকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের সারথীদের সামনে বলতে হবে কি করলে আমাদেরকে আমাদের মঞ্চে আর কোনদিনও কোন পূর্ণিমার কান্না শুনতে হবে না।

মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে খানিকটা ইতঃস্তত করছি। ভাবছি শুরুটা করবো কোথায় আর কোথায়ই বা শেষ। হঠাৎ মনে হল গলদতো আমাদের গোড়াতেই। শুধু কি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট আর ৩রা নভেম্বর? শুধুই কি জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস বিকৃতি আর জেনারেল এরশাদের আনুকূল্যে সেই বিকৃতির প্রসার? তাতো না।

আমাদের মননে আর চেতনায় ‘ভুলটা’-তো সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছে, ভিন্ন লেবাসে নিরপেক্ষতার দাবিদার কিছু অতি জ্ঞানপাপী। এখনো মনে আছে ’৯০-এর শেষে গণতন্ত্রের ‘সো-কলড্’ বিজয়ে যখন উদ্বেল আমরা এবং আরো সবাই, হঠাৎই আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হলো, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দিব’।

সেই থেকে শুরু, আজকের যে ভোটারের সেদিন জন্মও হয়নি তার মস্তিষ্কের নিউরনে-নিউরনেও অনুরণিত এই একই বেদবাক্য। সেই থেকে বাঙালি ভোট দিয়ে চলেছে যাকে খুশি তাকে আর ভেবেছে এতেই ঘটছে গণতন্ত্রের মহাবিজয়। ভোট পাচ্ছে ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, ১৫ আগস্টের খুনি, ২১ আগস্টের কুশীলব, বাংলা ভাইয়ের পৃষ্ঠপোষক আর সাথে সাবেক স্বৈরাচারও। কলঙ্কিত হচ্ছে আমাদের গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ পাদপীঠ, আমাদের জাতীয় সংসদ তাদের পদচারণায় আর আমরা ভাবছি, ‘বাহ্! এইতো বেশ - বেশ জিতছে গণতন্ত্র’!

আমরা কোরবানির গরু থেকে কাঁচা বাজারের সবজি সবই কিনছি দেখেশুনে বুঝে আর শুধু প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটটা দিয়ে আসছি যাকে খুশি তাকে। মাইকটা সামনে পেয়ে আমার বক্তব্য তাই স্পষ্ট, ’আমার ভোট আমি দিব, কিন্তু যাকে খুশি তাকে আর না। আমার ভোটের দাবিদার শুধুই স্বাধীনতার সপক্ষের প্রার্থী’।

আমরা ভুল করেছি ’৯১ থেকে বারবার, কিন্তু ২০১৮-তে আর নয়। এবারের যে প্রথম ভোটার, সে যেন পিছনে তাকিয়ে কোনদিনও এই ভেবে না পস্তায় যে তার একটি ভোটে জাতীয় সংসদে পা রেখেছিল একজন জামায়াতী কিংবা রাজাকার। হঠাৎ মনে হল প্রথম ভোটারের প্রথম ভোট স্বাধীনতার পক্ষেই হতে হবে আর সেটাই হবে আমাদের এবারের নির্বাচনে সবচাইতে বড় পাওয়া।

দিন গড়িয়েছে একে একে, ঘনিয়েছে নির্বাচন আর পরম সন্তুষ্টি নিয়ে দেখেছি এই একই উচ্চারণ লাখো-কোটি বাঙালির হৃদয়ে, শ্লোগানে। যারা ভেবেছিল বাঙালিকে বোকা বানানো কঠিন নয় মোটেও, তারাই বোকা বনে গেছে নির্বাচনের ফলাফলে। নির্বাচনে জিতেছে বাংলাদেশ। ১৯৭৩-এর পর এই প্রথম আমরা পেয়েছি একটি জামায়াতী আর রাজাকারমুক্ত জাতীয় সংসদ। ‘চখা রাজাকারের’ ছেলে মুক্তিযোদ্ধা সাজতে গিয়ে দেখেছে কি ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তার নিজ এলাকার মানুষ। আর ‘বাঙালির কাণ্ডারির’ দাবিদার প্রৌঢ়জন হতভম্ব হয়ে দেখছেন ‘তার হাতেই ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তি’ জাতীয় বস্তাপচা দাবি পচেছে বস্তাতেই।

এখন জামায়াতকে সাথে নেয়া যে কতবড় ভুল ছিল তার সাফাই গাচ্ছেন তিনি। দু’কোটিরও বেশি প্রথম ভোটার ভুল করেনি। যারা মনে করেছিল ‘গণতন্ত্র রসাতলে গেল’ রব তুলে এদেশের দু’কোটিরও বেশি ভবিষ্যতের কাণ্ডারিকে আরো একবার বিভ্রান্ত করতে পারবে, এবারের নির্বাচনের ফলাফল ছিল তাদের গালে সজোরে চপেটাঘাত। বাংলার তরুণ কাণ্ডারিরা ভুল করেনি ’৫২, ’৬৯ আর ’৭১-এ। ভুল করেনি তারা ২০১৮-তেও।

বাংলাদেশ বেতার যখন রেডিও বাংলাদেশ, আর বাংলাদেশ জিন্দাবাদের নিষ্পেষণে নির্বাসিত যখন জয় বাংলা, ‘দি ব্রোকেন স্যুটকেস এন্ড টর্ন টি-শার্ট’ তত্ত্বের ভেলকিতে বিভ্রান্ত বাংলার সেদিনের তরুণ সমাজের সব পাপ আজ মোচন করেছে তাদের উত্তরসূরিরা। নির্বাসনে আজ জামায়াতীরা, পরাজিত আরো একবার রাজাকাররা।

’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সের ময়দানে আত্মসমর্পণের যে ছবিটি কোটি বাঙালির মননে উজ্জ্বল, তারই পুনঃমঞ্চায়ন দেখলাম যেন ৩০ ডিসেম্বর সকালে। ভোট শুরু না হতেই ভোটের মাঠ ছেড়ে পালালো ধানের শীষের ২২ জামায়াতী প্রার্থী সাথে স্বতন্ত্র আরো ৩ জামায়াতী।

২০১৮’র শেষ দিনটি আমাদের সামনে নতুন করে শুরু করার আরেকটা সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের উত্তরসূরিরা। এবার আমাদের পালা আমাদের ভুলগুলো পিছনে ফেলে তাদের প্রত্যাশার প্রতিদান দেয়ার। ’৭০-এর নির্বাচনে একবার এই জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সেবার ৭০ শতাংশ ভোটারের সমর্থনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন করেছিলেন বাংলাদেশ। এবারের মেন্ডেট তারচেয়েও অনেক বড়। ৮৫ শতাংশ ভোটার কারো পিছনে দাঁড়ায়নি কখনোই। দাঁড়িয়েছে এবার, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নৌকা প্রতীকের সমর্থনে। এবারের মেন্ডেট খুবই পরিষ্কার। বাঙালি চায় বাঙালির বাংলাদেশ। উন্নয়ন আমাদের প্রত্যাশায়, জানি হবেও।

জননেত্রী সেই প্রত্যাশা পূরণের পথে এগুচ্ছেন দৃঢ় পায়ে। বাঙালির প্রত্যাশা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুধু একটি উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশই নয় বরং স্বাধীনতার সপক্ষের একটি রাজাকার-জামায়াতমুক্ত বাংলাদেশ, যেখানে জামায়াতে ইসলামী দণ্ডিত হবে ’৭১-এ সংগঠনটির কৃতকর্মের জন্য। জানি সে প্রত্যাশা পূরণও এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ধন্যবাদ বাংলার তারুণ্যকে, বাঙালিকে আরো একবার সঠিক পথটা চিনিয়ে দেয়ার জন্য।

লেখক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/পিআর