অশুভ শক্তিকে রুখতে হবে
প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। মনে করেছিলাম নববর্ষের ঠাট্টা বুঝি। কারণ উন্মাদ ছাড়া এসব বক্তব্য যে কেউ সত্যি সত্যি দিতে পারে একথা বিশ্বাস না হওয়াই স্বাভাবিক।
পরে ভিডিও ক্লিপিং দেখলাম। অজান্তেই চোখ চলে গেল ল্যাপটপ স্ক্রিনে প্রদর্শিত তারিখের দিকে। না, আমি ভুল দেখছি না। এটা ২০১৯ সাল। মধ্যযুগ নয়। এই সময়ে, বিশ্ব যেখানে রয়েছে সাইবারযুগে, যখন মহাকাশে পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ, যখন চিন্তাভাবনা হচ্ছে মঙ্গলে বসতি গড়ার। সেই সময়ে তিনি এ কী বলছেন? বলছেন, নারীদের স্কুল কলেজে পাঠানোর দরকার নেই, নারীদের কর্মক্ষেত্রে যাবার দরকার নেই। নারীদের দেখলে পুরুষের জিবে জল আসে কারণ তারা নাকি তেঁতুল।
আরও বলা হচ্ছে নারীরা স্কুল কলেজে গেলে নাকি তাদের পরপুরুষে টেনে নিয়ে যাবে। মেয়েদের একমাত্র কাজ স্বামীর আসবাবপত্র দেখাশোনা করা। তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণেরও দরকার নাই। কারণ সন্তান জন্ম দেওয়াই নারীর কাজ। শুধু তাই নয়, যে সমাবেশে একথা বলা হযেছে সেখানে উপস্থিত পনের হাজার মানুষ আবার প্রতিজ্ঞাও করেছে যে তারা তাদের কন্যাদের স্কুল কলেজে পাঠাবে না, বাড়ির ভিতরে আটকে রাখবে।
আহমদ শফী নামের ওই ধর্মোন্মাদের বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিলেও চলতো, কিন্তু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে ওই পনের হাজার মানুষের প্রতিজ্ঞাকে। শুধু গুরুত্ব নয়, আমি আতংকিত বোধ করছি। কারণ এই অশুভ তৎপরতা চলছে ধর্মের নামে।
ধর্মের নামে দেশে নারী বিরোধী, প্রগতি বিরোধী, উন্নয়ন বিরোধী তৎপরতা চালানোর এই উসকানিমূলক বক্তব্যকে হালকাভাবে নেওয়ার কোন অবকাশ নেই। কারণ ওই পনের হাজার মানুষ এবং আহমদ শফীর আরও অসংখ্য অনুসারী এই বক্তব্যে বিশ্বাস করে। আহমদ শফীর এই খবরটি যেসব অনলাইনে প্রকাশিত হযেছে সেখানে সংবাদের নিচে পাঠকের মন্তব্যগুলোও আমি মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। সেখানেও অনেক পাঠক তার এই বক্তব্যকে সমর্থন দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে ভাবছি আজকে যদি কোনো ধর্মগুরু বলে যে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে এবং পৃথিবী গোলাকার নয় সমতল সেটাও তারা বিশ্বাস করবে কি না।
এই ওয়াজের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেলে শফী আহমদ নিজের বক্তব্যকে কিঞ্চিৎ সংশোধন করে বলেন তিনি নাকি নারী শিক্ষা বিরোধী নন সহশিক্ষা বিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা যেই লাউ সেই কদু। কারণ নারী পুরুষ যদি একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়তে পারে, যদি কর্মক্ষেত্রে কাজ না করতে পারে তাহলে অর্থনীতি তো অচল হয়ে যাবে।
কলকারখানা, আদালত, ব্যাংক, হাসপাতাল, সকল প্রতিষ্ঠান কি নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা করে গড়া হবে? দেশের সড়কগুলো কি নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা হবে? বিমানবন্দর কি নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা হবে?
ধরলাম এই উন্মাদনা থেকে নারীরা সব কর্মক্ষেত্রে যাওয়া বন্ধ করলো। তাহলে কি হবে? বাংলাদেশের অর্থনীতি যে এক ঘন্টায় ধসে পড়বে সেকথা কি বলার অপেক্ষা রাখে? কলকারখানা, শিক্ষাক্ষেত্র, কৃষিক্ষেত্র, ব্যাংকিং সেক্টর, হাসপাতাল সব তো অচল হয়ে যাবে। কারণ দেশের শ্রমশক্তির অর্ধেক নারী। এই শ্রমশক্তিকে ঘরে আটকে রাখার ভয়াবহ পরিকল্পনা কীভাবে মানুষের মাথায় আসে এবং অন্যরা সেই পাগলামিকে সমর্থন দেয় সেটা আমি বুঝতে অপারগ।
শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন বাক স্বাধীনতার কথা। কিন্তু বাক স্বাধীনতা মানে কি এই যে একজন ব্যক্তি তার পনেরো হাজার অনুসারীকে প্রতিজ্ঞা করাবেন সংবিধান, সরকারি পরিকল্পনা, জাতীয় উন্নয়নের বিরুদ্ধে? দেশ ধ্বংসের কথা বলাকে কি বাক স্বাধীনতা বলা চলে? ইসলাম ধর্মের নামে এই অনাচার ও ধর্ম-বিরুদ্ধ বক্তব্য কি সহ্য করা উচিত?
কারণ ইসলামে কোথাও নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে কিছু বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ। বলা হয়েছে বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র। এখানে বিদ্বান বলতে তো নারী পুরুষ দুজনকেই বোঝানো হয়েছে। বলা তো হয়নি পুরুষ কেবল জ্ঞান অর্জন করবে, নারী শুধু সন্তান জন্ম দিবে।
তিনি আরও বলেছেন নারীরা শুধু নারী চিকিৎসকের কাছে যাবে। তাহলে নারী চিকিৎসক কোথা থেকে আসবে? আকাশ থেকে? ইসলাম ধর্মে যেখানে বিদ্যা অর্জনের উপর এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেখানে ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী এবং ইসলামকে জনসমক্ষে হেয়কারী এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সময় আসেনি কি?
এদের অশুভ তৎপরতা রুখতে সরকারি পদক্ষেপের প্রয়োজন অবিলম্বে। শফী আহমদের বক্তব্য শুধু নারী বিরোধী নয় তার বক্তব্য পুরুষকেও হেয় করে। কারণ নারীকে দেখলেই পুরুষের জিবে জল আসে, স্কুল কলেজে নারীকে দেখলেই পুরুষ তাকে টেনে নিবে এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে পুরুষকে পিশাচ বলে প্রতিপন্ন করা হয়।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ধর্মের অপব্যাখ্যায় মেতে উঠে তারা পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নকে রুদ্ধ করবে না। সেখানে ভয় নেই। কিন্তু ভয় হলো এই ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্যে দেশের কতিপয় ধর্ম-পাগলের পাগলামি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই এই অশুভ শক্তিকে কোন রকম আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। সরকারিভাবে এই অশুভ শক্তির তৎপরতা রুখতে হবে। নইলে দায় এড়াতে পারবে না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বলে পরিচিত বর্তমান সরকারও।
আর শুধু সরকার নয়। প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য এই অশুভ বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদ জানানো। যদি আপনি বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, যদি মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়ে থাকেন, যদি আপনি প্রকৃত মুসলমান হয়ে থাকেন তাহলে এই নারীবিরোধী, ধর্মবিরোধী, দেশবিরোধী, মানবতা বিরোধী বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদী হোন।
লেখক : কবি, সাংবাদিক। চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
এইচআর/পিআর