ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রধানমন্ত্রীই সব মন্ত্রণালয়ের ভরসা

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯

গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিবারণের ভরসাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশনার আগ পর্যন্ত সাতদিনেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর ঘোষণা আসেনি। প্রধানমন্ত্রী পোশাক শ্রমিকদের মজুরি যৌক্তিকহারে বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

রবিবার শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব আফরোজা খান চূড়ান্ত মজুরি ঘোষণা করেন। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম, এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, আতিকুল ইসলামসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে আপাতত ফয়সালা হলো শ্রমিক বিশৃঙ্খলার।

এর আগে, বিজিএমইএ থেকে শ্রমিকদের আল্টিমেটাম দিয়ে বলা হয়েছিল, শ্রমিকরা কাজে না ফিরলে সোমবার থেকে সকল ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেয়া হবে। এরও আগে, নতুন মজুরি কাঠামো অনুযায়ী প্রতিশ্রুত মজুরি প্রদান এবং মজুরি কাঠামো পরিবর্তনের দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলেছে পোশাকশিল্প শ্রমিকদের আন্দোলন। সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।

যাত্রীবাহী বাসসহ যানবাহন ভাঙচুরও হয়েছে। পুলিশের জলকামান, গরম পানি, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপও চলেছে যথারীতি। পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যদের মহড়াও বাদ পড়েনি। এ ধরনের ঘটনায় যা হয়েই থাকে। আর পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ও নানা মন্দ কথাতো চলেছেই। কখনো বলা হয়েছে, ষড়যন্ত্র চলছে। পেছনে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, তৃতীয় পক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এটা করছে।

এ ধরনের কথাবার্তায় কোথাও দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টাই প্রতীয়মান হয়েছে। ব্লেইম গেম প্লে না করে সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা হয়নি। কোনো দাবি দাওয়ায় দ্রুত রেসপনস করতে পারার সক্ষমতা-দক্ষতা কেউ দেখাতে পারেননি। অপেক্ষার মধ্য দিয়ে যেন সাভারের গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যুটাকে অনিবার্য করে তোলা হয়েছে। এটি এড়ানোর কি কোনো পথ ছিলো না?

গার্মেন্টস শ্রমিকরা রাস্তায়- এই তথ্য সবারই জানা ছিলো। তার চেয়েও বড় কথা নতুন সরকারের মন্ত্রীদের শপথের দিনই এ আন্দোলনটা শুরু। একদিকে চলেছে মন্ত্রীদের শপথ, আরেকদিকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন। একদিকে শ্রমিক আন্দোলন, আরেকদিকে, নতুন মন্ত্রীদের ‘শুভেচ্ছা’ জানানোর ঠেলাঠেলি। তাই বলে কি এ আন্দোলনের দিকে ভালোভাবে নজর দেয়ার সময় হয়নি?

না-কি তেমন ইস্যু মনে হয়নি। প্রশাসনের, রাজনীতির, সরকারের সবারই দৃষ্টি নির্দিষ্ট কোনোদিকে থাকলে আশপাশের দিকে কেউ আর তাকানোর দরকার মনে করে না। মন্ত্রীদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর তথ্যচিত্রের ভীড়ে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের খুন হওয়ার খবরটাও গণমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব পায়নি। এরপরও উল্লাসের পাশে একটি খুনের খবর তথ্যচিত্র হয়েছে ছোট করে হলেও। শেষে অবশেষে প্রধানমন্ত্রী এটিকে ঘটনা মনে করায় অন্যদের গায়ে লেগেছে। ব্যস্ততা এসেছে। ফয়সালাও এসেছে।

এ ইস্যুতে ছাত্রলীগের রাস্তায় নামা বা তাদের রাস্তায় নামানোও জরুরি ছিল না। এতে বড় রকমের অঘটনও ঘটতে পারতো। ১২ জানুয়ারি রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড়ে শ্রমিকদের অবরোধ দমনে আকস্মিকভাবে মাঠে নামে স্থানীয় ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। অবরোধ দুই ঘণ্টা হওয়ার পরও সেখানে মালিক সংগঠন, কিংবা পুলিশের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা ছিল না।পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাংলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে সড়কে অবস্থান নিতে যায়।

ছাত্রলীগের নেতারা পোশাকশ্রমিকদের মুখোমুখি হওয়ার পর ধাক্কাধাক্কি হয় সেখানে। মুহূর্তের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিকদের মধ্যে। তাদের মোকাবেলায় আশপাশ থেকে জড় হতে থাকে শ্রমিকরা। ঘটনা বেশি দূর যাওয়ার আগেই সেখান থেকে কেটে পড়ে ছাত্রলীগ। পরে দুপুর ১টার দিকে টেকনিক্যাল মোড় থেকে সরে দাঁড়ায় শ্রমিকরা। এতে ওই সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।

ছাত্রলীগকে নিয়ে শেষপর্যন্ত ঝামেলা গুরুতর পর্যায়ে না গেলেও ভেতরে ভেতরে আচ্ছারকমের ক্ষত তৈরি হয়েছে সিভিল ও সেনাপ্রশাসনের মধ্যে। পোশাক শ্রমিক অসন্তোষ দমনে সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় সিভিল প্রশাসনের এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিজিবির মেজরের হেকমতের দৌড় মারধরে গিয়ে ঠেকে।

সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনের শেষদিনে ১৩ জানুয়ারির ঘটনাটি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে। এ ঘটনায় আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। মেজরের মারধরে আহত ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার রাজিবুল ইসলামকে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও পানি সম্পদ সচিব কবীর বিন আনওয়ার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিজিবির ঢাকা সেক্টর সদর দপ্তরে কর্মরত এই মেজর রহমতের হাতে ম্যাজিস্ট্রেট রাজিবুল মারধরের শিকারের বিষয়টি তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাভারের ইউএনও শেখ রাসেল হাসান একে নাম দিয়েছেন বিধিবহির্ভূত ঘটনা। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত। সাভারে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা জানান, শ্রমিক অসন্তোষ দমন বা নিয়ন্ত্রণে সেখানে আইন-শৃঙ্খল রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন ১২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

সেদিন সকালে বিজিবির একটি দলের সঙ্গে সাভারের উলাইল এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাজিবুল ইসলাম। আর বিজিবির দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মেজর রহমত। রাজিবুল সেখানে যাওয়ার পরে মেজর রহমত তাঁকে ‘আল মুসলিম’ পোশাক কারখানার ভেতরে একটি রুমে নিয়ে বসান।

রাজিবুল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ বিষয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছেন সেখানে তিনি লিখেছেন, আল মুসলিম কারখানার ভেতরে ওই রুমে মেজর রহমত তাঁর অধীনস্ত বিজিবির দুই সদস্যকে ডেকে বলেন পরিস্থিতি খারাপ হলে সরাসরি গুলি করতে। ম্যাজিস্ট্রেটকে জানানো হবে পরে। বিষয়টির প্রতিবাদ করে রাজিবুল বলেন, নিয়মানুযায়ী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়েই গুলি করতে হবে।

এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে মেজর রহমত চড়াও হন রাজিবুলের ওপর। কিল-ঘুষি লাথি মারেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। বেচারা কোনো রকমে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে রাখা গাড়ির কাছে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরে জেলা প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারা গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনার জন্য টানা সাতটি দিন অপেক্ষা না করে শ্রমিকদের শান্ত করার ন্যূনতম উদ্যোগ নিলেও ঘটনা কি এতোদূর গড়াতো ? আরো প্রশ্নটা হচ্ছে, সব সমস্যার সমাধানেই প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হবে? তার নির্দেশের আগ পর্যন্ত মন্ত্রী বা মান্যবরদের করণীয় কিছু থাকে না? প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কিছু কাজ থাকে। সেই কাজগুলো করার প্রথম দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর। সেই দায়-দায়িত্ব, অধিকার নিয়েই তার ওজারতি। আর কারো এখতিয়ার বা নির্দেশনা পরবর্তী ব্যাপার।

প্রতিটি কাজেই যেই মন্ত্রী ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া দৈনন্দিন রুটিন কাজও করতে পারেন না- তারা আসলে দায়িত্ব পালনে কতো যোগ্য বা নিয়ন্ত্রিত, অসহায়- প্রশ্নটা থেকেই যায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে নিজের মন্ত্রণালয়ের কাজ নিজে নিজেই করতে পারঙ্গম- এমন নজির বড় দুর্বল আগে থেকেই।

সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীরা বেশ কিছু মন্ত্রণালয় নিজের হাতেই রাখেন। বিশেষভাবে দেখাশোনা করেন আরো কিছু। বাদবাকিগুলোও কম-বেশি তদারকি করেন। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতাটাই ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রীর সংকেত বা মর্জি না বোঝা পর্যন্ত কোনো মন্ত্রণালয়ের ফাইলই ঠিকভাবে চলে না। এবারের নতুন মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরাসরি অধীনে রেখেছেন ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এগুলো হচ্ছে-মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

গতবারের মতো এবারও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিদর্শন করবেন তিনি। বলা হয়ে থাকে, কাজে গতিশীলতা আনতে ও প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিতে এবারও প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে যাবেন। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিদর্শন করেছিলেন তিনি। আগামী ১৭ জানুয়ারি তার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু হবে। এরপরই ২৩ জানুয়ারি যাবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমএস