চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ– ‘সুশাসন’
বিজয় প্রত্যাশিত ছিল, তবে এত বড় বিজয় হবে কিনা তা খোদ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরাও হয়তো আঁচ করতে পারেননি। দল প্রধান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, ক্যারিশমা এবং নেতৃত্বের গুণে ১৯৭৩-এর পর আবার একটি বড় বিজয় এলো দলের জন্য।
যে সংসদ গঠিত হয়েছে, তাতে বিরোধী দল সংখ্যায় নগণ্য। এই ক্ষীণ কণ্ঠস্বর নিয়ে সংসদ কতটা গণমুখী আইন করতে পারবে এবং কতটা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারবে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। তবে আমাদের প্রত্যাশা এই যে, বঙ্গবন্ধু কন্যা তার পিতার পথেই হাঁটবেন। বঙ্গন্ধু তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বক্তৃতায় বলেছিলেন, যদি একজনও ন্যায্য কথা বলে তিনি মেনে নেবেন। এই সংসদে সেই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে বলে বিশ্বাস করতে চাই।
গণতন্ত্র মানে কেবল শাসকের অভিপ্রায় নয়, বিরোধীদেরও কথা বলার পূর্ণাঙ্গ অধিকার স্বীকৃত। বিএনপি ও তার জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর যৌথ আন্দোলন সহজেই হিংসাত্মক হয়, তা সত্য। তবুও সংসদে এই অল্প সংখ্যক সাংসদ বড় জায়গা পাবেন সংসদীয় বিতর্কে, সেটা প্রত্যাশা। তবে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট যদি শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তবে তা হবে গণতন্ত্রের জন্য এবং তাদের নিজেদের জন্য বিপজ্জনক।
আলোচনা চলছে এ কারণে যে, বেশি বড় বিজয়ের পর ক্ষমতাসীন দলকে কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বড় বিজয় বড় দায়িত্ব এবং তারা সচেতন আছেন। প্রতিপক্ষের উপর কোন ধরনের হামলা যেন না হয়, তা নির্বাচনের ফল পেয়েই নির্দেশ দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।
তারপরও একটি ঘটনা ঘটেছে যা সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। নোয়াখালির সুবর্ণচরে এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং অভিযুক্তরা সবাই সরকারি দলের। আশার কথা এই যে, প্রশাসন ও পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে, আসামীদের আটক করা হয়েছে।
আমাদের মনে আছে ২০০১-এর নির্বাচনের ফল আসতে শুরু করার পরপরই বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা সারাদশে হিন্দু ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শুধু ভোলার লালমোহনের একটি গ্রামেই ধর্ষিতা হয়েছিল শতাধিক নারী। এই ধর্ষণ উৎসব চলেছিল বছর ব্যাপী। তৎকালীন সরকার গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের কোন আবেদন নিবেদনই গ্রাহ্য করেনি, ধর্ষক নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সেদিক থেকে এই ঘটনায় বর্তমান সরকার ও তার দলের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক।
অনেকেই বলছেন, এটি রূপালি রেখার আভাস, সুশাসনের শুরু এখান থেকেই। বড় বিজয়, বড় দায়িত্ব এবং ইশতেহারে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির দিকে নজর দিলে বলতেই হবে, এক নতুন রাজনীতি আজ ক্ষমতাসীন দলের সামনে উপস্থিত। তার চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ– দুটোই ‘সুশাসন’। অর্থাৎ সুশাসন দেয়াটা কঠিন আবার সুযোগও এটাই। আমরা দেখি আগামী পাঁচটি বছর সরকার কি দেয় আমাদের।
দেশে সুশাসন চালানোই যে একটি নির্বাচিত সরকারের জনাদেশ, এটা শেখ হাসিনা বোঝেন। আমরা দেখেছি বারবার গণতন্ত্রের স্বার্থেই তিনি নমনীয় হয়েছেন, সৌজন্য বোধ দেখিয়েছেন। খালেদার পুত্রের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি বিএনপি প্রধানের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু দরজা খোলা হয়নি তার জন্য।
২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে তিনিই ফোন করে আহ্বান জানিয়েছেন, প্রায় সবকিছু ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। কারণ তিনি ভাল করে জানেন, শাসক পক্ষের দিক হতেই নমনীয়তা বেশি দেখাতে হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াতে মৌলবাদীদের সুযোগ দিয়েছেন। তার পরিণামে দেশের উদীয়মান অর্থনীতিই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বিরোধীপক্ষও বিপজ্জনক জায়গায় চলে গিয়েছিল যার পরিণাম এবার তাদের ভরাডুবি।
রাজনীতিতে জনপ্রিয়তাবাদ একটি পরিচিত বিষয়। বলা হয়, জনপ্রিয়তাবাদের মৌলিক সীমাবদ্ধতা হলো এটি সমাজের মৌল রূপান্তর আনেনা। কিন্তু দ্বিধাহীনভাবে কাজের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে পরিবর্তন সম্ভব। গত দশ বছরে একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছে এদেশে, দেশের নানা অঞ্চলে। দেশ নানাভাবে এগিয়ে গিয়েছে নানাদিকে। শিক্ষা বিস্তারে, রাস্তাঘাট নির্মাণে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে, সামাজিক কল্যাণ এবং সুরক্ষায়, কৃষিতে, পরিবেশ রক্ষা এবং উন্নয়নে। এসবের থেকে কী শিক্ষণীয়, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যথেষ্ট ভাবেন কি?
কখনও কি আমরা ভেবেছি, দেশে যে এত এত বড় কাজ হল, মৌলিক কাজ হল তার কারণ কী? এসব মানে কী শুধুই অর্থ ব্যয়? আমার মনে হয় ক্ষুদ্রতা থেকে বেরিয়ে এসে সবচেয়ে বড় পাওয়া রাজনৈতিক নেতৃত্বের বড় কাজ, বড় স্বপ্নের প্রতি মনোযোগী হওয়া। শেখ হাসিনা সেটি করেছেন। এখন বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করতে পারেন নানা স্থানে যেসব ভাল কাজ হয়েছে, হচ্ছে, দেশের প্রশাসনের যে সুবিপুল এবং বিচিত্র, বহুগামী অভিজ্ঞতা, তার পিছনের কারণ উদ্ঘাটনে।
সরকারের দশ বছরের কাজের আলোচনায় স্বভাবতই শেখ হাসিনার শাসন পরিচালনার পরিবর্তিত ভঙ্গি এবং সক্রিয় ও তৎপর প্রশাসন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃঢ়তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সবাই কথা বলছে। তবে নির্বাচনের আগে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, তার দোষ ত্রুটি থাকলে ক্ষমার চোখে দেখতে। দেশবাসী তাকে উপচেপড়া ভালবাসা দিয়েছে। এখন তিনি যা অনুভব করেন, সে অনুযায়ী তার নিজস্ব শাসনপদ্ধতির ত্রুটিসমূহ নিজে বিশ্লেষণ করবেন।
আশা করা যায়, প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতে এসব সংশোধন করতে যথোচিত মনোযোগ দিবেন। প্রশাসন সম্পর্কে সমাজের ধারণা কী রূপ, তাও তুচ্ছ করলে চলবে না। কেবল সুশাসনই যথেষ্ট নয়, তার পদ্ধতিও যথাযথ হতে হবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস