নিরঙ্কুশ বিজয় প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়
গণতন্ত্রকামী মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার সুষ্ঠু প্রতিফলনের মাধ্যমে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ একাই লাভ করেছে ২৫৯টি সংসদীয় আসন। নির্বাচিত সকলকে আমরা জানাই অভিনন্দন ও খ্রিস্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা। বলে রাখা ভালো যে, এই নির্বাচনে মানুষ মহাজোটকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এজন্য সাধারণ মানুষকেও ধন্যবাদ ও স্বাগত জানাই।
পূর্বেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের জরিপে ওঠে এসেছিল জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয় সম্ভাবনার চিত্র। ৩০ ডিসেম্বর ছিল কেবল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র! অবশেষে সেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। চতুর্থবারের মতো বিজয় নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।
চতুর্থ বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং টানা তৃতীয় বারের মতো- অর্থাৎ এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদে জননেত্রী ‘হ্যাটট্রিক’ করলেন। পাশাপাশি, এই বিজয়ের মধ্যে দিয়ে আরেকটি সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো- দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠার জন্য পাঁচ বছর পরপর রাষ্ট্রক্ষমতায় দল পরিবর্তন বড় কথা নয়- বড় কথা হলো ক্ষমতাসীনদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন। আত্মমর্যাদার সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মেধা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে সহঅবস্থান নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে জাতিকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ।
বিগত দশ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি আমরা সরকারকে যত্নশীল কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে দেখেছি বলেই এদেশের মানুষ জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা স্থাপনে বিশ্বাসী হয়েছে। আর বিশ্বাসী হয়েছে বলেই টানা তৃতীয় বারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় জনগণ জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছে- শেখ হাসিনাকে পুনর্বার প্রধানমন্ত্রীরূপে এদেশের মানুষ দেখতে চেয়েছে বলেই ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়েছে। তাকে ‘হ্যাটট্রিক’ করার সুযোগ দিয়েছে।
জনগণ ভুল করেনি। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং একই সাথে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনগণের ভোটের রায় ও সঠিক সিদ্ধান্তের ফলে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় বারসহ চতুর্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। এই শুভ লগ্নে আমরা তাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন এবং নিরন্তর শুভেচ্ছা। একই সাথে আমরা অগ্রিম শুভেচ্ছা জানাই সম্ভাব্য নতুন মন্ত্রিপরিষদের সকল সদস্যকে- নতুন বছরের শুরুতে নতুন মন্ত্রিপরিষদকে খ্রিস্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
চতুর্থ বারের প্রধানমন্ত্রী এবং ‘হ্যাটট্রিক’ করা প্রধানমন্ত্রীর এবারের বিজয়ে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের আস্থা ও আকাঙ্ক্ষার কাছে চতুর্থ বার প্রধানমন্ত্রীত্বের শপথ নেওয়ার প্রাক্কালে আমরা মানুষের কিছু আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি এইক্ষণে তুলে ধরতে চাই। যা তিনি তার বিগত অভিজ্ঞতার আলোকে দেশবাসীকে উপহার দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী, এদেশের জনগণকে আপনি পদ্মাসেতু উপহার দিয়েছেন, মেট্রো-রেল উপহার দিয়েছেন, উপহার দিয়েছেন বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন নামের বিভিন্ন ‘মেগা’ প্রকল্প। যুদ্ধাপরাধীর বিচার উপহার দিয়ে আপনি সমগ্র জাতিকে করেছেন কলংকমুক্ত। যে কলংক-কালিমায় বিগত চারটি দশক দেশের ভাগ্যললাট ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রেরণা ছিল সতত অনিশ্চিত আশংকার মুখোমুখি- আপনি তা থেকে এদেশ ও এদেশের মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো সাড়া জাগানো কর্মকাণ্ড পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কি না জানি না- আপনার দিকনির্দেশনায় বিগত কয়েক বছর ধরে বছরের প্রথম দিন দেশের সকল স্কুলে একসাথে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর মাঝে নতুন নতুন বই উপহার দিয়েছেন। আমাদের সময়ে যা ছিল কল্পনাতীত! বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীর হাতে সকল বিষয়ের বই পৌঁছে দেওয়ার এমন গর্বিত নজির পৃথিবীর কোন দেশেই নেই। আপনি এ কাজটি করেছেন। আপনার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে শিক্ষার হারবৃদ্ধি! বর্তমানে শিক্ষার মান-উন্নয়নের বিষয়ে আপনার মনোযোগ আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সাফল্যে পর্যবসিত হবে। সামাজিক সক্ষমতার সকল সূচকে দেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন আপনি। আপনার নেতৃত্বে আমরা আন্তর্জাতিক আইনে সমুদ্র বিজয় করেছি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিজয় করেছি অনন্ত আকাশও।
উপরন্তু, আপনিই ২০৪০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ও অশিক্ষামুক্ত ‘উন্নত’ রাষ্ট্র গড়ে তোলার এক স্বপ্ন দেশবাসীর মনে বপন করেছেন। আপনি বিগত দশ বছরে দেশে স্থিতিশীলতা রক্ষা করেছেন সাফল্যের সঙ্গে- যা উন্নয়নের পূর্বশর্ত। ১৩, ১৪ ও ১৫ সালের কয়েকটি মাস ছাড়া বিগত দশ বছরের টানা স্থিতিশীলতায় দেশে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে মাথাপিছু প্রবৃদ্ধিও।
বিগত দশ বছরের মতো আর কোন সময় দেশের ভেতরকার স্থিতিশীলতা নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘস্থায়ীত্ব অর্জন করতে পারেনি। প্রায় নিরবচ্ছিন্ন স্থিতিশীলতার ফলেই অর্থনীতিসহ সামাজিক সক্ষমতার সকল সূচকে বাংলাদেশ কেবলই সম্মুখের দিকেই এগিয়ে গেছে। যা পার্শ্ববর্তী অনেক রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। ইতোপূর্বে বিভিন্ন মেয়াদে জনগণের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেছেন বলেই রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আপনার সাফল্যের পাল্লা অতীতের যে কোন সময়ের যে কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে ভারি।
জনগণের আস্থা সৃষ্টিতে সেসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নই আপনাকে এবারের সাফল্যের দিকে নিয়ে গিয়েছে। তাই এদেশের মানুষ আবারো আপনাকে নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়ে তাদের ভোট দিয়ে আপনাকে এবং আপনার প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করেছে। আমরা সাধারণের সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানাই, তাদেরকেও অভিনন্দন জানাই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারলে আজকে বিগত সাফল্যের সূত্র ধরে যে বিজয় নিশ্চিত হলো তা পরবর্তী বিজয়কেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে।
রাষ্ট্রপ্রধান বা সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আপনার সাফল্য এখন আর উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। বিদেশি গণমাধ্যম আপনাকে ‘কর্তৃত্ববাদী’ বলে সম্প্রতি যে বিশেষণ যুক্ত করেছে এখন আপনাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বনেতা হিসেবে আপনার ক্রম-অবস্থানকে আরো সুউচ্চে তুলে তার জবাব দিতে হবে। ‘কর্তৃত্ববাদী’ বলে তারা আপনার নেতিবাচক সমালোচনার প্রতি ইংগিত করলেও আপনি তা ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন। আমরা আপনার এই ‘স্পিরিট’কেও অভিবাদন জানাই।
পাশাপাশি, আপনার প্রতি এ প্রত্যাশাও ব্যক্ত করতে চাই যে, আপনি আপনার রাজনৈতিক মেধা ও প্রজ্ঞাকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে মেলে ধরবেন। এদেশের মানুষ আপনাকে সেই সুযোগটি এবার ভোটের মাধ্যমে করে দিয়েছে। ফলে আপনার প্রতি আমাদের প্রত্যাশা আরো আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে।
এবার আমরা আপনার কাছে চাই একটি স্বচ্ছ, দক্ষ, সৎ ও গতিশীল মন্ত্রিপরিষদ। বিগত টানা দুই মেয়াদে আপনার চোখে যারা পরিশ্রমী, দেশপ্রেমী, কর্মঠ, দক্ষ, সৃজনশীল, সর্বোপরি সততা ও দক্ষতার মাধ্যমে নিজেদেরকে ‘যোগ্য’ প্রমাণ করেছে তাদেরসহ নবীন কিংবা অপরাপর প্রবীণ নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে আসন্ন চতুর্থ মন্ত্রিপরিষদ গঠন করুন। আমরা আপনার কাছে চাই সুদক্ষ, সৎ, পরিশ্রমী, দেশপ্রেমী এবং সৃজনশীল মন্ত্রী বাহিনী নিয়ে পূর্বের তুলনায় আরো শক্ত হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করুন।
‘তলা বিহীন ঝুড়ি’র অপমানজনক অপবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করে মর্যাদাশালীরূপে গড়ে তুলতে আপনিই জনগণের সম্মুখে মেলে দিয়েছেন অবারিত স্বপ্ন। অনুন্নত রাষ্ট্র থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এবং পরে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে ‘উন্নত’ রাষ্ট্রের এক অসীম সাহসী স্বপ্নবীজ এদেশের মানুষের মধ্যে আপনিই তো সঞ্চার করেছেন। এইবার, আপনার এই চতুর্থ মেয়াদে উন্নত রাষ্ট্রের লক্ষ্যাভিমুখে যাত্রায় দেশবাসী আপনাকে দিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন।
আপনার স্বাপ্নিক দর্শন ও অভিপ্রায় নিয়ে আপনি এগিয়ে চলুন। বাংলাদেশ চলবে আপনার সঙ্গে। দুঃখিনি বাংলাদেশকে আপনি স্বপ্ন দেখিয়ে দেখিয়ে কর্মোদ্যমে দেশবাসীকে আত্মনিয়োগের সুযোগ দানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলুন। দেশ এগিয়ে যাক- এগিয়ে যাক এদেশের মানুষ। দারিদ্র্যের সীমারেখা অতিক্রম করে ধনী ও উন্নত জীবনের অধিকারী হয়ে উঠুক। যে অভিপ্রায়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল সে লক্ষে এদেশের মানুষকে নিয়ে চলাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, আপনার সাধ।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ আপনার মাধ্যমে সমাপ্ত হোক। আপনার মাধ্যমে এদেশ প্রকৃত সোনার বাংলা হয়ে উঠুক। আপনার স্বপ্নদর্শন ও উন্নয়নের হাত ধরে বাংলাদেশ প্রকৃত সোনার বাংলা হয়ে উঠুক। এজন্য আপনার একটি কঠোর নির্দেশনাই শুধু প্রয়োজন- আর তা হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপনার সহনশীলতাকে একেবারে শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনা।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে তাঁর গুণগুলোও আপনার মধ্যে আছে- তা হলো আপনিও অনেককে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু অযোগ্যদের ক্ষমা না করে ছাটাইয়ের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে কিছুটা কঠোর হলেও সর্বসাধারণের কাছে আপনার যে বার্তাটি পৌঁছাবে তা সাধারণের ব্যক্তিক সক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র, অনেক অপপ্রচারের পরও একটি সফল নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের মধ্যে স্থিরবুদ্ধি ও সুবিবেচনা নিয়ে যে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করা সহজ কথা নয়। কিন্তু সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলার মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। এজন্য সকল নিন্দুকের মুখের ওপর তুড়ি মেরে সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে। আর দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়েও কুণ্ঠিত হওয়ার অবকাশ নেই।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম