ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

একজন গর্বিত চিকিৎসকের পেশা বন্দনা

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল | প্রকাশিত: ১২:৫১ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

হাঁটছি তো হাঁটছি। ভর দুপুরে শীতের দিনে। রোদের প্রখরতা কম, তবে ঠিক সহনীয়ও না। এরই মাঝে হাঁটছি। গন্তব্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি।

সাথে হাঁটছেন সাড়ে তিন হাজারের বেশি চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট আর হাসপাতাল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এসেছেন তারা ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে। সাথে সহযাত্রী বঙ্গবন্ধু গবেষণা সংসদের সহযোদ্ধারা। এ হাঁটা অবশ্য প্রথম না। হেঁটেছি অনেক, হেঁটেছি নিয়মিতই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাসে জয় বাংলা শ্লোগান মুখে।

কখনো কখনো হেঁটেছি ময়মনসিংহের রাজপথে আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিতে-গলিতে। এখনো হাঁটিনা তা নয়, তবে হাঁটি অনেক কম। হাঁটি নানা কারণে। এইতো সেদিন সম-মনাদের নিয়ে হাঁটলাম মানিক মিয়া এভিনিউ ধরে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে ২৫ জামায়াতির কলঙ্ক থেকে পবিত্র ব্যালটকে কলঙ্ক মুক্ত করার দাবিতে। হেঁটেছি সদ্যই সিলেটের রাজপথে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহযোদ্ধাদের সাথে। রাজাকার আর জামায়াত মুক্ত একাদশ জাতীয় সংসদের প্রত্যাশায়।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যায় সোহরাওয়ার্দী থেকে বঙ্গবন্ধু অব্দি কম-বেশি পাঁচ কিলোমিটারের ঐ পদযাত্রা। এ হাঁটায় আমার সহযাত্রী আমার পেশার সহযোদ্ধারা। এ যেন পূর্বসূরিদের দেখানো পথে উত্তরসূরিদের শ্লোগানমুখর উৎসব যাত্রা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের হতে মনে পড়ছে ৫২’র ফেব্রুয়ারিতে এমনি এক শীতের দিনেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের আব্দুল আলীম চৌধুরীরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পৃথিবীর প্রথম ভাষা শহীদ মিনার। ছাত্রত্ব আর ক্যারিয়ারের তোয়াক্কা করেননি। ৫৩’র ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসে কালো পতাকা উত্তোলনের অপরাধে হাসিমুখে কারাবরণও করেছিলেন আলীম চৌধুরী আর ফজলে রাব্বীরা ।

মনে পড়ছে ৭১’র অসংখ্য শহীদ চিকিৎসককে। মুক্তিযুদ্ধের শেষপ্রান্তে তাদের অনেককেই এখান থেকে খুব কাছেই মোহাম্মদপুরে ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিল নিজামী-মান্নানের নেতৃত্বে আল বদরের ঘাতকরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন আত্মসমর্পণের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনি নির্মম নির্যাতন করে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়েছিল তাদের ছিন্নভিন্ন নিথর দেহ।

প্রতিথযশা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আব্দুল আলীম চৌধুরীর চক্ষু কোটরের পাশেই ছিল বেয়নেটের গভীর ক্ষত আর হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ফজলে রাব্বীর হৃদপিন্ডই বক্ষগহ্বর থেকে বের করে নেয়া হয়েছিল। তাদের অপরাধ ছিল একটাই, সরকারি চাকরির তোয়াক্কা না করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা আর জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দেয়া। এরা প্রত্যেকেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসে তাদের সময়ে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অথচ তাদের অবর্তমানে তাদের বংশধরেরা কাটিয়েছেন মধ্যবিত্তের জীবন। কারণ অর্জিত প্র্যাকটিস লব্ধ সবটুকুই তারা উজাড় করে দিয়েছিলেন মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে।

স্বাধীন দেশে গুলিবিদ্ধ শেখ কামাল। রাষ্ট্রপতির ছেলে অথচ ঢাকার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়াতেন কোন নিরাপত্তা প্রটোকল ছাড়াই। কখনো ফুটবল, কখনো ক্রিকেট, কখনো আবার মঞ্চ নাটক কিংবা ছাত্রলীগের তাগিদে ছুটে চলায় মাথায় রাখেননি চারিদিকে চলমান যত চক্রান্ত। গুলিবিদ্ধ যখন শেখ কামাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সির গেটে তখন তার জন্য উদগ্রীব অপেক্ষায় ছিলেন না মহামান্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের কোন কর্মকর্তা। ছিলেন একজন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। দৌড়িয়ে, ঝাঁপিয়ে নিশ্চিত করেছিলেন গুলিবিদ্ধ শেখ কামালের চিকিৎসা। হাঁটতে হাঁটতে যখন ২৭ নম্বর ট্রাফিক সিগন্যাল পার হচ্ছি কেন যেন কানে খুব বেশি করে বাজছে গত ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মদিনে সতীর্থ স্বজন আয়োজিত শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের স্মৃতিচারণে উঠে আসা এই তথ্যটুকু।

কানে বাজছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের উপাচার্য আর সেদিনের ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়ার স্মৃতিচারণও। নিজ কানে শুনেছি তার নিজ জবানিতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ১৫ আগস্টের শহীদদের সারি-সারি রক্তাক্ত মরদেহ দেখতে আর শ্রদ্ধা জানাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন অন্য পেশার অন্য কেউ নন। গিয়েছিলেন একজন কনক কান্তি বড়ুয়া আর সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আরো কিছু ক্ষ্যাপা ছাত্রই।

হাঁটতে হাঁটতে যখন শাহবাগের মোড়টার কাছাকাছি, ক্লান্তি যখন ভর করছে একটু-একটু করে। পা দুটোকে অনেক কষ্টে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ একঝলক অনুপ্রেরণা। ঐতো কাছেই টিএসসি। ওখানেই ৯০’র ডিসেম্বরে এমনি এক শীতের দিনে ঘাতকের গুলিতে ঢলে পড়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন সরকারি শিক্ষক। শহীদ ডাঃ মিলনের ঐ আত্মাহুতিতে মিলে-মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নানা পেশার শত শহীদের আত্মত্যাগ। রিকশা থেকে ডাঃ মিলনের ঢলে পরা নিথর দেহ গদি থেকে টেনে নামিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদের সামরিক শাসককে।

৯১’এ আমরা গণতন্ত্র পাইনি। গণতন্ত্রের ক্যারামেল কোটিং-এ পেয়েছিলাম স্বৈরশাসনের তেতো পুডিং। সংখ্যালঘু নির্যাতন আর আওয়ামী নিধনের সেই কালো অধ্যায়ের অবসানে সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জনতার মঞ্চ। তাতেও আমার পূর্বসূরিদের বরণীয় অবদান। এই মঞ্চের উদ্যোক্তা যেমন প্রতিথযশা আমলারা তেমনি ভুলবার নয় অর্থোপেডিক্সের অধ্যাপক ডাঃ কাজী শহীদুল আলম, ফার্মাকোলজির তরুণ শিক্ষক ডাঃ ইসমাইল খানকেও। আর একজন অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ মোদাসসের আলী - ভুলি কি করে তাকেও। আজ সরকারি কার্যালয়ে জাতির জনকের প্রতিকৃতি সগৌরবে প্রদর্শিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যখন পরাধীন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিজ কার্যালয়ে জাতির জনকের প্রতিকৃতি সবার আগে প্রদর্শন করে জাতিকে সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছিলেন এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ।

মনে পড়ছে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিথর আইভি রহমান আর ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর শতচ্ছিন্ন নিঃস্তব্ধ দেহগুলো। শাহবাগ থেকে কতইবা দূর আর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সেদিনের সেই সভাস্থল। গ্রেনেডে আহতদের চিকিৎসায় এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটেছেন অধ্যাপক ডাঃ রুহুল হক। সঙ্গে ডাঃ রউফ সরদার, ডাঃ এহসানুল কবির জগলুল, ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়ার মত নাম জানা-না জানা আরো কতজনাইতো। আহত হয়েছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজেও। নিজের আহত কানের চিকিৎসায় আস্থায় নিয়েছিলেন অধ্যাপক ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্তকে।

কখন যেন পৌঁছে গেছি বঙ্গবন্ধুর বটতলায়। গগন বিদারী শ্লোগানে উচ্চকিত চারিদিক। আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে নৌকার শ্লোগানে গলা মেলাচ্ছেন আমার অনুজ তরুণ তুর্কিরা। আর আমার মনে পড়ছে মাত্র দশটি বছর আগে এই বটতলারই আরেক দৃশ্যপট। সদ্য জানা গেছে গ্রেফতার হয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ১-১১’র অনির্বাচিত সরকারের সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ আঘাত গণতন্ত্রের ভিত্তিমূলে। এই বটতলাতেই সেদিনকার তরুণ তুর্কি অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়ার নেতৃত্বে হাতে গোনা ক’জন চিকিৎসকের যে প্রতিবাদী মিছিল, সেই মিছিলে ক’কদম হেঁটেছি এই আমিও।

ফেস্টুনে-ব্যানারে-শ্লোগানে উৎসবমুখর বটতলায় দাঁড়িয়ে আমার এতটুকুও ক্লান্তি নেই। আমার শুধু মনে হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বাংলাদেশ আমাদের পূর্বসূরিদের যে পর্বতসম অবদান, নগণ্য আমি সে তুলনায়, যে কোন বিবেচনায়। তবুও গর্বে বুক ফুলে-ফুলে উঠছে। মনে হচ্ছে পূর্বসূরিদের ঋণ সুধেছি আজ। হোক না বিন্দুসম, তাতে কি? প্রগাঢ় প্রশান্তিতে আচ্ছন্ন মন। চেম্বারের পথ ধরব এখন। আবারও পেশায় ফিরে যেতে কেন যেন তাগিদ অনুভব করছি।

কৈফিয়তঃ স্বাধীনতার সপক্ষের প্রার্থীদের সমর্থনে স্বাধীনতার সপক্ষীয় চিকিৎসক ও নার্সদের উদ্যোগে আয়োজিত সাম্প্রতিক একটি র‌্যালিতে অংশ নিতে গিয়ে নিতান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলোর প্রকাশ এই লেখাটি। কাউকে মহিয়ান করা যেমন উদ্দেশ্য নয়, তেমনি কোনভাবেই চাইনি জ্ঞাতসারে কাউকে অস্বীকার করতেও। আমার অজ্ঞতার জন্য হয়ত বাদ পড়েছে কারো নাম। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টির জন্য অনুরোধ থাকল। পেশার বাইরেও চিকিৎসকদের একটি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কত যে অবদান তার একটি খণ্ডচিত্র এটি। এ বিষয়ে বিশদ গবেষণার অবকাশ অনেক। অনুজ কেউ সেই উদ্যোগ নিবেন, প্রত্যাশা রইলো।
লেখক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমকেএইচ