কৃতঘ্নতার রাজনীতি ও দুজন ভুলে যাওয়া মানুষ
ছেলেবেলায় তিনটি শব্দ শিখেছিলম- কৃতজ্ঞ, অকৃতজ্ঞ এবং কৃতঘ্ন। উপকারীকে যিনি মনে রাখেন তিনি কৃতজ্ঞ। উপকারীকে যিনি ভুলে যান তিনি অকৃতজ্ঞ। আর যিনি উপকারীর ক্ষতি করেন, তিনি কৃতঘ্ন। বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক দুটি ঘটনায় অনেকদিন পর তৃতীয় শব্দটি মনে এলো। আমাদের দেশে রাজনীতিতে কৃতঘ্নতার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। সাম্প্রতিক দুটি উদাহরণ নিয়েই কথা বলবো আজ।
আজ যে সরকার বিরোধী বৃহত্তর জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে আশ্রয় ধরে জামায়াতকে সঙ্গে করে নির্বাচনী জোট পার হতে চাইছে বিএনপি, সেই ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অন্যতম কুশীলব ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। এই ব্যারিস্টার আবার ১/১১ এরও অন্যতম কুশীলব।
ব্যারিস্টার মইনুল আর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী- এই দুই দলবিহীন মানুষ অনেক দৌড়ঝাঁপ করে নানান কিসিমের মানুষকে একফ্রন্টে শামিল করলেন। এখানে আওয়ামী বিরোধী শক্তির নেতৃত্ব দেয়া দল বিএনপি যেমন আছে, আছেন ড. কামাল, কাদের সিদ্দিকীর মত বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্যরাও। এখন সবার একটাই চাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের অপসারণ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো সরকারের অপসারণ চাওয়া অপরাধ নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক। সরকারি দল থাকতে চাইবে, বিরোধী দল সরাতে চাইবে। সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। অপরাধ না হলেও সরকারি দল নানা পন্থায় বিরোধী দলকে দমন করতে চায়। কখনো সেটা আইনী প্রক্রিয়ায়, কখনো বেআইনীভাবে।
ব্যারিস্টার মইনুল আর ডা. জাফরুল্লাহও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করতে গিয়ে সরকারের রোষাণলে পড়েন। বিরোধী মতকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা এক কথা আর মামলা-হামলা করা আরেক কথা। তবে ঐক্যফ্রন্টের দুই মূল উদ্যোক্তা ব্যারিস্টার মইনুল আর জাফরুল্লাহ বিপাকে পড়েছেন নিজেদের কথার কারণে।
জাফরুল্লাহ প্রায়ই উল্টাপাল্টা কথা বলে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। তবে সেনাপ্রধানকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি বিতর্কের ঝড় তোলেন। শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেছেন জাফরুল্লাহ। তবে সাভারে তার গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে হামলা হয়েছে। জমি দখলের অভিযোগে মামলাও হয়েছে।
জাফরুল্লাহ বেঁচে গেলেও কারাগারে যাওয়া থেকে বাঁচতে পারেননি ব্যারিস্টার মইনুল। টক শো'তে নারী সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বলায় দায়ের করা এক মামলায় গত ২২ অক্টোবর থেকে কারাগারে আছেন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড় ছেলে ব্যারিস্টার মইনুল।
এই ছেলেকে বিলেতে পড়াশোনা করিয়েছেন মানিক মিয়া। তার মন-মানসিকতা, অনেকটাই সামন্ততান্ত্রিক। চালচলন কেতাদুরস্ত। সবকিছু বিলেতি কায়দা। খালি একজন নারীর সাথে কী আচরণ করতে হয়, তা শিখতে পারেননি। তার খেসারত দিতে হচ্ছে কারাগারে থেকে।
আমার দুঃখ হলো, যে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের জন্য এতকিছু করলেন, বিএনপি আইসিইউ থেকে বের করে নির্বাচনের ধারায় আনলেন; সেই ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপি তাকে বেমালুম ভুলে গেছে। প্রার্থী মনোনয়ন, ইশতেহার, নির্বাচনী প্রচার- কোথাও ব্যারিস্টার মইনুলের নাম নেই। যেন এই নামে কেউ ছিলই না।
শহীদুল আলম কারাগারে যাওয়ার পর দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কিন্তু ব্যারিস্টার মইনুলের জন্য কেউ একটা বিবৃতিও দেয়নি। আহারে বেচারা। ঐক্যফ্রন্ট আর বিএনপির এই নীরবতা ব্যারিস্টার মইনুলের কারাবাস দীর্ঘায়িত করছে।
তবে আমার ধারণা, ব্যারিস্টার মইনুলের এই পরিণতির জন্য তার কথাবার্তায় অসংযমই দায়ী। কারাগারে যাওয়ার আগে ফাঁস হওয়া দুটি টেলিফোন কথোপকথনে শোনা যায়, তিনি ড. কামাল হোসেনকে কাপুরুষ বলেছেন। আরেকজনকে তিনি বলেছেন, তারেক রহমানের নেতৃত্ব ধ্বংস করতেই তারা ড. কামালকে এনেছেন।
এখন ড. কামালকে যিনি কাপুরুষ বলেন ঐক্যফ্রন্ট কেন তার পাশে থাকবে। যিনি তারেক রহমানের নেতৃত্ব ধ্বংস করতে চান, বিএনপি কেন তার পক্ষে দাঁড়াবে। সব মিলে গ্যাড়াকলে পড়েছেন ব্যারিস্টার মইনুল। আমার বেচারার জন্য খারাপই লাগছে।
আরেকজন মানুষের জন্য আমার খারাপ লাগছে। বাংলাদেশের দুজন মানুষকে আমি সাহসী হিসেবে বিবেচনা করি। একজন সাংবাদিক নুরুল কবির, আরেকজন আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। ১/১১এর সময় যখন অনেক বাঘা বাঘা সাংবাদিক ও আইনজীবী গর্তে লুকিয়ে ছিলেন, এই দুজন তখন সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমার আজ খারাপ লাগছে এই সাহসী মানুষের একজন সানাউল্লাহ মিয়ার জন্য। শুধু ১/১১এর সময় নয়, গত ১২ বছর ধরেই তিনি বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের পক্ষে আইনী লড়াই চালিয়ে আসছেন।
ছোটখাটো মানুষটি এত সাহস কোত্থেকে পান, আমি ভেবে অবাক হই। সানাউল্লাহ মিয়া বিএনপির জন্য যা করেছেন, তাতে তিনি যা চাইবেন, তাই দেয়া উচিত। বিএনপির প্রার্থী মনোনয়নের সময় সানাউল্লাহ মিয়াও মনোনয়নন চেয়েছিলেন।
সানাউল্লাহ মিয়া নির্বাচন করতে চাইলে, বিএনপির উচিত ছিল এক নাম্বারে তার নামটি বসিয়ে তারপর অন্য আলোচনা শুরু করা। কিন্তু আমি বিস্ময়ের সাথে দেখলাম, সানাউল্লাহ মিয়া মনোনয়ন পাননি। নরসিংদী-৩ আসনে তার বদলে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে মঞ্জুর এলাহী নামে এক ব্যবসায়ীকে। বিএনপির বিরুদ্ধে যে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই সানাউল্লাহ মিয়া।
বিএনপি তাকে কিভাবে বুঝিয়েছে, সান্ত্বনা দিয়েছে, জানি না। তবে চেয়েও মনোনয়ন পাননি, এটা জানার পর সানাউল্লাহ মিয়ার মনে যে কষ্ট হয়েছে, তার পরিণতি ভোগ করতে হবেই বিএনপিকে। দলকে ভালোবাসেন বলে হয়তো সানাউল্লাহ মিয়া প্রতিবাদ করেননি, বিদ্রোহ করেননি। তারপরও বলবো, এটা অন্যায়, ভীষণ অন্যায়।
ব্যারিস্টার মইনুল আর সানাউল্লাহ মিয়াকে ভুলে যাওয়ার ঘটনায় এটা আবার প্রমাণিত, রাজনীতিতে ভালোবাসা বলে কিছু নেই। শুধুই স্বার্থপরতা। নির্বাচন প্রচারণা আর হামলা-পাল্টা হামলায় দেশ যখন উত্তাল, তখন আমি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আর এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়াকে স্মরণ করে রাখলাম। তাদের জন্য আমার গভীর সমবেদনা।
এইচআর/জেআইএম