নির্বাচন যেন নির্যাতনে পরিণত না হয়
শাহরিয়ার কবিরের এক অসামান্য প্রামাণ্যচিত্রের প্রদশর্নীতে আলোচনা সভায় এক সংখ্যালঘিষ্ট সম্প্রদায়ের নেতা শিরোনামে উল্লিখিত কথাগুলো বলেছিলেন। এই আলোচনা সভায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ও উপস্থিত ছিলেন।
শাহরিয়ার কবিরের এই “ভুলি নাই” শিরোনামে চিত্রটি উৎসর্গ করা হয় বরেণ্য নেতা ও দেশপ্রেমিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে। এটি একটি যথাযর্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য বটে। ১৯৪৮ সালের ২৩/২৪ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের গণপরিষদে শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাব করেছিলেন যে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হোক। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বাঙগালিরা সংখ্যাধিক্য হওয়া সত্বেও একজনও তাকে সমর্থন জানাননি।
এখানে উল্লেখ্য যে ভারত ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে। সে পরিস্থিতিতে শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অসামান্য সাহস এবং দেশ প্রেমের পরিচয় দিয়েছে। যা হোক ভাষা আন্দোলনে তার এই স্বীকৃতি অনেক পরে তাও কিঞ্চিৎ দেয়া হয়েছে। নির্মূল কমিটির অবিসংবাদিত নেতা শাহরিয়ার কবির নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান রোধ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্যাতনের বিরুদ্ধে।
তিনি বেশ কয়েকটি চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং দেশে ও বিদেশে প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর কেন নির্যাতন হয়, এটাই বোধগম্য নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলায় সব ধর্মের লোক এক সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ৭১ সালে ভারতে সব বাংলাদেশের লোকের পরিচয় ছিল জয় বাংলা।
স্বাধীনতার পর বিক্ষিপ্ত ভাবে সম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু সংগঠিতভাবে ভয়াবহ আকারে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ২০০১ সালে যার নেতৃত্বে ছিল বিএনপি জামায়াত। ২০০১ সালে তত্বাবধাক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় যেখানে বিএনপি জামায়াত জোট সংসদের তিন চতুথাংশ আসনে জয়ী হয়ে তাদের সরকার গঠন করে দেশের কাজে লাগার কথা । সেটিকে গৌণ মনে করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং লুট হত্যা, ধর্ষণ চালায় পাকিস্তান বাহিনীর স্টাইলে।
অবশ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপরও কম নির্যাতন চালায়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জামায়াত বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার একতরফা নির্বাচন করেছিল বললে অত্যক্তি হয় না। যাই হোক না কেন এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কি ভূমিকা ছিল?
সংসদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতনিধির সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ ১৬২টি নির্বাচিত আসনের ১৬০টিতে জয়ী হয়েছিল। যেখানে মাত্র একজন হিন্দু সদস্য ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৯১ সালে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। সেসময় সংখ্যালঘুর উপর কোনরকম নির্যাতন ঘটেনি।
এতে মনে করা হয় যে যখন জামায়াত ইসলাম বিএনপির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হলো তখনই এই তাণ্ডবলীলা শুরু হয়। যাক আর কদিন পর একাদশ জাতীয় নির্বাচন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মূল জনসংখ্যার তুলনায় শতকরা ৮ ভাগ। অথচ তারা শংকিত, আতংকিত এর চেয়ে লজ্জা এবং বেদনা কি হতে পারে।
এই আলোচনা সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বক্তব্য রাখেন তার কথায় বোঝা গেল যে বিষয়টি নিয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত। তাই তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন কোন রকম। সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনা যেন না ঘটে।
এ ব্যাপারে তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করছেন। কাজী রিয়াজের মত রবীন্দ্রভক্ত আমলা অন্যের চেয়ে বেশি মানবতাবাদী হওয়া স্বাভাবিক। শাহরিয়ার কবির জীবনকে বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০৪ সালে তিনি উত্তরবঙ্গে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন। দুজন সঙ্গী মারা যান। নির্মূল কমিটির সেক্রেটারি কাজী মুকুল এবং তিনি শুরুতর রূপে আহত হন।
যেভাবে আকস্মিক দুটো মোটর সাইকেল তাদের গাড়ির সামনে এসেছিল তাতে মনে করা হয় পরিকল্পিতভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল। দুর্ঘটনার পর শাহরিয়ার কবির এবং মুকুলকে রংপুর সিএমএইচএ নেয়া হয়েছিল। জায়গার অভাবে ভর্তি করা হয়নি। চিকিৎসা দেয়া হয়নি।
ঢাকায় হেলিকপ্টারের উড়াল দিতে ১২ ঘন্টা দেরি হয় তাদেরকে আনার জন্য। এসব কোন অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে ঘটেছে, তা আজও অনুদঘাটিত। ভুলি নাই চিত্রে ২০০৪ এবং ২০১৪ সালের নির্যাতনের চিত্র দেখানো হয়েছে যা পূর্বের ছবিগুলোতে আছে। কিন্তু এই ছবিতে একটি নতুন তথ্য সংযোজিত হয়েছে যা আমাদের চিন্তা এবং উদ্বেগের কারণ। সেটা হলো আইএসআই কানেকশন। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স (আইএসআই)।
বাংলাদেশের জামায়াত ইসলামসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে আইএসআই অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক তথা ব্যক্তিত্ব এই ঘটনা নিশ্চিত করেছেন তাতে অবিশ্বাস করার কোন সুযোগ নেই। জামায়াতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর পুত্র এবং পাকিস্তানের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হায়দার ফারুখ মওদুদী লাহোরে তার বাসায় দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে পাকিস্তানের জামায়াতের এজেন্ডা যেন বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হয়, তার জন্য পাকিস্তানের আইএসআই অর্থ প্রদান করে থাকে।
তাকে সমর্থন করে পাকিস্তানের খ্যাতিমান সাংবাদিক হামিদ মীরও বলেছেন বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দলকে আইএসআই কর্তৃক অর্থ সরবরাহের বিষয়টি। তার এই তথ্যের উৎস হচ্ছে এক সময় বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানের একজন রাষ্ট্রদূত এবং স্বয়ং নওয়াজ শরীফ যার প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে এ ঘটনা ঘটেছে। এই দুই ব্যক্তির সচিত্র বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ভুলি নাই চিত্রে। অতএব একে অস্বীকার করা বা মিথ্যে বলার সুযোগ নেই। যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। কেননা এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমেত্বে আঘাত এবং বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানানোর প্রচেষ্টা।
৩০ লক্ষ শহীদ এবং ৩ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার উপর আঘাত প্রতিহত করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। আশা করি এবারে নির্বাচন পরবর্তীতে কোন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটবে না। ইতোমধ্যে নির্বাচনী ইশতেহারে বিএনপি জানিয়েছে যে তারা ক্ষমতার গেলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় খুলবে।
আওয়ামী লীগ বলেছে যে সংখ্যালঘু নিরাপত্তা কমিশন গঠন করবে। তবে কথায় বলে বেড়া ক্ষেত খেলে ঠেকায় কে? ২০০১ এবং ২০১৪ সালে বিএনপি জামায়াতের কর্মীরা ঘটনা ঘটিয়েছে। আবার ২০১৬ সালে যশোর শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে গিয়েছিলাম সেখানে দেখলাম শাসক আওয়ামী লীগের কিছু সদস্যের নির্যাতনে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছে কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য।
মূল কথা রাজনৈতিক দলের শৃঙ্খলা থাকতে হবে। নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। আদর্শ রাজনৈতিক কর্মী বাহিনী থাকবে রাজনৈতিক দলে। তাহলে সব ঠিক থাকবে। প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা প্রদানতো সাংবিধানিক দায়িত্ব। সংবিধানের উপরতো আর কোন দলিল বা আইনের প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস