ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

খুচরাদের পাইকারি নির্বাচন

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ০৯:২৪ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮

জনে-ধনে খুচরা হলেও ভোটের মাঠে শুরুতে বেশ আদর-সমাদর জুটছিল খুচরা দলগুলোর। লাস্ট রাউন্ডে এসে খেলখতম না হলেও তারা মাঠে কিছু একটা। জোট-ফ্রন্টের উছিলায় বড় দুই দলেই তারা গা-গতরে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ভোটের মাঠে শক্তি-সামর্থ না থাকলেও, এমন কি নিবন্ধন না থাকলেও জোটগতভাবে তারা যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগে ফ্যাক্টর। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বা সমাবেশেও জোরালো বক্তব্য রাখার সুযোগ মিলছে। অনেকটা অনায়াসে পজিশন মিলছে বড়দলের বড় নেতার পাশে। আবার জোটের ভেতরে জোট এবং একদলের একাধিক জোটে শরীক থাকা এবারের নতুনত্ব।

জোট প্রশ্নে ভোট বেশ প্রাসঙ্গিক। দলও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু দেশে বর্তমানে জোটের সঙ্গে দলও অগুণতি। নির্বাচন কমিশনের হালখাতায়, দেশে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৩৯। আর অনিবন্ধিত দুই শতের মতো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে নিবন্ধিত দল আটটি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে ৮টি। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন ৫৯ দলীয় জোটে নিবন্ধিত দল রয়েছে তিনটি।

সিপিবি-বাসদের নেতৃত্বাধীন আট দলের জোটে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা তিন। আর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বহুল আলোচিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা তিনটির মতো। নিবন্ধিত বাকি ১৫টি দলের মধ্যে সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে মাত্র একটির। এটির নাম বিএনএফ। জোটে দলের সংখ্যা বিচারে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও কম নন। তার দলের নাম তৃণমূল বিএনপি। তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে শরিক হয়েছেন।

আবার তার নিজেরও নেতৃত্বাধীন জাতীয় জোটে ৯টি দল রয়েছে বলে দাবি তার। ১৪ দলের কাছে ব্যারিস্টার হুদা তার দেয়া দলের তালিকা অনুযায়ী দলগুলো হচ্ছে- তৃণমূল বিএনপি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, সম্মিলিত ইসলামিক জোট, কৃষক শ্রমিক পার্টি, একামত আন্দোলন, জাগো দল, ইসলামিক ফ্রন্ট ও গণতান্ত্রিক জোট। এরমাঝে আবার সম্প্রতি ৮-দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোট নামে একটি ফ্রন্টও ঘোষণা হয়েছে।

বাংলাদেশে কোয়ালিশন সরকার ব্যবস্থা বছর কয়েকের হলেও জোটপ্রথা বেশ পুরনো। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জোট রাজনীতি গুরুত্ব পেতে থাকে। এর আগে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো মুসলিম লীগ ও সদ্য গঠিত ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ একটি সংসদীয় ঐক্য গঠন করে। তবে, পরে তা টেকেনি।

উল্লেখ্য স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে। জোট রাজনীতি পর্যালোচনায় এ ধরনের কিছু ঘটনা বাদ দিলে দেখা যায়, আদর্শের চেয়ে ক্ষমতাই বেশি ফ্যাক্টর। মাঠের রাজনীতিতে ডান-বাম, সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িক, উন্নয়ন-সংবিধান ইত্যাদির কথা বলা হলেও ভোট ও ক্ষমতার প্রশ্নে সবাই একার।

এ বাস্তবতার মধ্যেই বাংলাদেশে এখন মহাজোট, ১৪ দল, ২০ দল, ঐক্যফ্রন্ট, যুক্তফ্রন্ট ইত্যাদি মোর্চার পথচলা। প্রধান দুই দলের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যও ছোট দলের নেতারা জোট গঠনের ঘোষণা দেন। নির্বাচন সামনে রেখে দল ভাঙা, নতুন দল গড়া, জোট গঠন, পাল্টা জোট গড়া, সংলাপ, আলাপ, বিভিন্ন জায়গায় চা চক্র বা ভোজে মিলিত হওয়ার মূল রহস্য এখানেই।

এসবের মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণিত রাজনীতিতে যেমন চিরশত্রু বা মিত্র বলতে কিছু নেই, তেমনি শেষ কথা বলেও কিছু নেই। আজ যে জোটে আছে, কাল সে নাও থাকতে পারে। আবার নতুন করেও কোনো দল জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। জোট-ফ্রন্ট, মোর্চার ইতিহাসে ৫৪-র যুক্তফ্রন্টের কথা এসেই যায়।

ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে এর জন্ম। আদর্শিক মিল না থাকলেও কিছু কমন ইন্টারেস্টে গোটা পাকিস্তান কাঁপিয়ে যুক্তফ্রন্ট জন্ম নেয়। এতে সম্মিলন ঘটে তখনকার বাঘা বাঘা নেতাদের। মানুষের কাছে তারা দেবতুল্য হয়ে ওঠেছিলেন। সেই ফ্রন্টও ক্ষমতার প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়।

 

আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ ভোটের মাঠে কমছে কম দশ-এগারোটি জোট সক্রিয়। ভোটের অংক সবক্ষেত্রে মুখ্য হয়নি। ভোট-নিবন্ধন থাক বা না থাক তাদেরকে পাইকারিতে ভ্যালু দেয়ার চেষ্টা করেছে দুই জোটই। ক্ষুদ্র হলেও তারা বড়দের জোটে ঢুকেছে-বেরিয়েছে, এটাও প্রাপ্তি। আসন বিলিবন্টনে মহাজোটের পরিচয়ে শরীকদের দিয়েছে ৪২টি আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি-জাপা ২৬টি, জেপি ২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৫, জাসদ (ইনু) ৩, জাসদ (আম্বিয়া) ১টি, তরিকত ফেডারেশন ২টি, ও যুক্তফ্রন্ট ৩টি। তবে মহাজোটের বাইরে গিয়ে জাতীয় পার্টি ১৪৮টি আসনে এককভাবে নির্বাচন করছে।

নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) শীর্ষ ৩ নেতা। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনে শাহ জিকরুল আহমেদ, গাইবান্ধা-৩ আসনে এসএম খাদেমুল ইসলাম খুদি, রংপুর-২ আসনে কুমারেশ চন্দ্র রায় ও বরিশাল-৬ আসনে মো. মোহসীন নির্বাচন করবেন দলীয় প্রতীক মশালে।

অন্যদিকে বিএনপির দরবারে খুচরাদের ছাড় দেয়া হয়েছে তুলনামূলক বেশি। বিএনপির ফ্রন্টও জোটগত পরিচয় দু’টি। একদিকে ২০ দলীয় জোট। আরেকদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। শরিকদের ৫৯টি আসনে ছাড় দিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের ৪০টি। আর ঐক্যফ্রন্টকে ১৯টি।

২০ দলীয় শরিকদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে ২২টি, এলডিপিকে ৫, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ৪, জাতীয় পার্টি (জাফর) ২, খেলাফত মজলিস ২, বিজেপি ১, এনপিপি ১, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১, লেবার পার্টি ১, পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশকে ১টি আসন দেয়া হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে দেয়া ১৯টির মধ্যে গণফোরাম ৭, জেএসডি ৪, নাগরিক ঐক্য ৪ ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে ৪টি। এর বাইরে কক্সবাজার-২ আসনে জামায়াতের প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে লড়বেন। এ আসনে বিএনপি কোনো প্রার্থী দেয়নি। আর পাবনা-১-এ মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ও চাপাইনবাবগঞ্জ-৩-এ নুরুল ইসলাম বুলবুলকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রেখেছে দলটি।

বড় দুই জোটের বাইরে বাম গণতান্ত্রিক জোট লড়ছে ১৪৭ আসনে। আটটি দল নিয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোটের দলগুলো হল- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। তাদের মধ্যে নিবন্ধন রয়েছে সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির।

এদিকে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) পাঁচটি আসনে দলটির প্রার্থীকে হুক্কা প্রতীক দিতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে দিনাজপুর-১ আসনে মো. আরিফুর ইসলাম, ঢাকা-১৮ এসএম শাহাদাত, পঞ্চগড়-২ ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান, যশোর-৫ মো. নিজামউদ্দিন অমিত ও পঞ্চগড়-১ আসনে আল রাশেদ প্রধানকে দলীয় প্রতীক দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ এক চিঠিতে দলের প্রধানসহ তিনজনকে দলীয় প্রতীক গাভী দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। তারা হলেন- জেবেল রহমান গানি, সুমি আক্তার শিল্পী ও মো. ওয়াজি উল্লাহ মাতব্বর অজু। কুড়িগ্রাম-৪ ও পিরোজপুর-২ আসনে দলের প্রার্থীকে দলীয় প্রতীক বাইসাইকেল দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে জাতীয় পার্টি-জেপি। এছাড়া, হাতপাখা প্রতীকে ২৯৮ আসনে লড়বে ইসলামী আন্দোলন।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর