ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচনী মৌসুম : চা না কফি?

নাসরীন মুস্তাফা | প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

‘চা? না কফি?’
গলা ভেজানোর প্রস্তাবে এরকম অপশন বহু বার পেয়েছি। আপনিও পেয়েছেন নিশ্চয়ই। নির্বাচনের মৌসুমে এই প্রশ্ন তো হয়ে যায় জাতীয় প্রশ্ন। এই মুহূর্তে লেখাটি পড়তে পড়তে কাপে চুমুক দিয়ে কোন্ তেঁতো তরলের স্বাদ নিচ্ছেন, বলুন তো? চায়ের? না কফির?

মানুষের ডিএনএ-তে ক্যাফেইনের স্বাদের প্রতি টান কতটা থাকবে, তার মাত্রা নির্দিষ্ট করা থাকে বলে জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। মানুষের ডিএনএ-তে জিনগত ভিন্নতা আছে বলে সবার পছন্দ এক নয়। কেউ চা ভালবাসেন, কেউ কফি ছাড়া আর কিছুতে গলা ভেজান না, কেউ কেউ চা বা কফি যে কোন একটা হলেই চালিয়ে নেন। আমি এই শেষ দলভুক্ত।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাহবা দিতে থাকি চা’কে। ছন্দময়তা, শান্তি, আত্মিক উৎকর্ষ, আত্মিক জাগরণ, আত্মিক সংযোগ স্থাপন, তরতাজা হয়ে ওঠার, বদলে দেওয়ার প্রতীক চা। চুমুকে চুমুকে তাজা-এই ট্যাগলাইন তো বিজ্ঞাপনে এমনি এমনি আসেনি। বিজ্ঞানীরা সবুজ চা’য়ে ক্যাটেচিন নামের এক রকমের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট খুঁজে পেয়েছেন, যা শরীরের ফ্যাটকে জ্বালানির মতো পুড়িয়ে দেয় বলে ওজন কমে, মাংসপেশির কার্যক্ষমতা বাড়ে।

চা হৃৎপিন্ডের শক্তি বাড়ায়। সকাল সকাল চা পান মানে, মেজাজ শান্ত থাকবে, কেননা এতে আছে এল-থিয়ানাইন, থিওফিলাইন এবং থিইন। এমনও শুনেছি, কেউ যদি স্বপ্নে নিজেকে গরম আদা চা পান করতে দেখেন, তবে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি আসবেই আসবে। এরকম স্বপ্ন দেখব বলেই তো ঘুমাতে যাই।

চা-সংস্কৃতি বলে একটি কথা আছে, যা দিয়ে বোঝানো হয় চা তৈরি করা এবং পান করার নানান সংস্কৃতিকে। পথের পাশের ভাসমান চাওয়ালার কাছ থেকে চা কিনে খাওয়া যেমন এক সংস্কৃতির কাজ। আরেক সংস্কৃতিতে চা পান করতে হলে চারপাশটা সাজিয়ে মৃদু যন্ত্রসঙ্গীত শুনতে হয়। কোন্ মিডিয়ায় চা কিভাবে উঠে আসছে, তা দেখাও এই সংস্কৃতির কাজ। বৃটিশরা আফটারনুন টি-তে অভ্যস্ত। তিব্বতে চায়ের সাথে লবণ আর মাখন থাকতেই হবে। ঠিক একইভাবে ইথিওপিয়ানরা কফি ওরফে বুনা পান করে।

একইভাবে কফি-সংস্কৃতিরও জয়জয়কার চলছে বলে কফির কাপে চুমুক দিয়ে ভাবতে থাকি। যদিও চৌদ্দ শতকেই তুরস্ক থেকে শুরু হয়েছিল কফি পান আর কফি হাউজ সংস্কৃতি, অটোম্যান সুলতান সুলেমানের সময় থেকে। ঐতিহ্যবাহী মাটির পাত্রে কফি পান চলে মেক্সিকোতে। স্প্যানিশ ভাষায় এর নাম ক্যাফে দে ওলা।

সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশে কালচে রঙের তিতকুটে স্বাদের গাওয়া খাওয়ার নিয়ম হচ্ছে, সবচেয়ে প্রবীণকে আগে দেওয়া হবে, তারপর একে একে বাকিরা। কফি যত কাল হবে (নরকের মতো কাল), যত শক্তিশালী হবে (মৃত্যুর মতো শক্তিশালী) এবং যত স্বাদের হবে (ভালবাসার মতো স্বাদের), তত সে কফি সেরা, এই বিশ্বাস আছে তুর্কীদের। রাতের খাবারের পর তামার পাত্রে পরিবেশিত তুর্কী কফি কাহ্ভেসি খেতে হয় চকলেট চিবাতে চিবাতে।

সামাজিক অভ্যেসগুলো কফি পানের উপর নির্ভরশীল কতটা, তা দিয়ে পরিমাপ করা হয় কফি-সংস্কৃতির প্রভাবকে। এসপ্রেসো কফি বিশ শতকের শেষ দিকে এসে পশ্চিমা জগতে এবং বিশ্বের অন্যান্য নগর-জীবনে প্রভাব খাটাতে শুরু করেছিল। ১৮ শতকে লন্ডনে যেভাবে শুরু হয়েছিল কফি হাউজের যাত্রা, সেই থেকে কফি হাউজ বলতে ভাবা হয় শিল্প-সংস্কৃতির আলাপের তুফান ছুটানো জায়গাকে।

মান্না দে’র ‘কফি হাউজ’ গানটি শুনলে সমস্যা হয় না বুঝতে, কফি পান করুন আর না করুন, কফি হাউজের আড্ডাতে মাইদুল-সুজাতাদের সাথে কত ভাল সময় কাটানো সম্ভব হতে পারে। ল্য দ্য ম্যাগোটস নামের জনপ্রিয় কফি হাউজ আছে প্যারিসে, যার সাথে জড়িয়ে আছে জ্য পঁল সার্ত্রে এবং সিম্যন দ্য বুভ্যেরার নাম। স্টারবাকস আমেরিকাতে এই ধারণাকে বদলে দিয়ে সরাসরি কফি পানের স্টাইলে এনে ফেলে, যেখানে কফি পানে আগ্রহীদের জন্য একটু উঁচু টুল, শত শত এসপ্রেসো কফি স্ট্যান্ড থাকছে। এখন যোগ হয়েছে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবস্থা।

কফি ব্রেক-কে বলা হয় ফিকা। সুইডেনে এই ফিকা মানে হচ্ছে অফিস ও ব্যবসা-কেন্দ্রে নিয়ম মেনে সামাজিক আড্ডা আর হালকা নাস্তা খাওয়া। ১৯ শতকের শেষ দিক থেকে আমেরিকার উইসকনসিনের স্টাউটন শহরে এই ব্রেক চালু করেছিলেন নরওয়েজিয়ান অভিবাসীদের স্ত্রীরা। এখন তো প্রতি বছর এ নিয়ে উৎসব হয় শহরটিতে। আমেরিকান সংস্কৃতিতে কফি ব্রেক এখন অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। ১০ থেকে ২০ মিনিটের ব্রেক, কর্মঘন্টার প্রথম কোয়ার্টার শেষ হলেই নিতে হয়।

১৯ শতক থেকে শুরু হওয়া চা পানের বিরতি বা টি-ব্রেক বৃটিশদের না নিলে চলে না। কাজের ফাঁকে টি ব্রেক নিলে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে, কাজে মনোযোগ আসে, এই বিশ্বাস জোরদার, বিজ্ঞানসম্মতও বটে। যদিও শিল্প বিপ্লবের সময় (১৭৬০-১৮২০) মালিকপক্ষ শ্রমিকের এই টি-ব্রেক অধিকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল এই যুক্তিতে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সময় নষ্ট করা হয়। ১৮৪০ সালে বেডফোর্ডের সপ্তম ডাচেস আনা আফটারনুন টি চালু করেন, যা কখনোই বিকেল চারটার আগে নিতে হয় না।

আগে মানুষ বিশ্বাস করত, মানুষ তিতা স্বাদের খাবার এড়িয়ে চলে। তিতা স্বাদ হচ্ছে বিষের উপস্থিতির প্রতীক, ভাবনাটা ছিল এমনই। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, মানুষের ডিএনএ-তে জিনের একটি সংস্করণ আছে, যা ক্যাফেইনের তিতকুটে স্বাদের প্রতি স্পর্শকাতরতা বাড়ায়। যাদের জিন বেশি তিতাতেও টলে না, তারা কফি-খোর। যাদের জিন তিতার বেশি মাত্রা নিতে পারে না, তারা চা-খোর। সায়েন্টিফিক রিপোর্টস পত্রিকার নভেম্বর সংখ্যায় এরকমও বলা হয়েছে, তিতা সহ্য করার এই মাত্রা নির্দেশ করে জিন অন্য পদার্থের তিতকুটে স্বাদ (যেমন ঔষুধের স্বাদ) কতটা নিতে পারবে।

এই বিজ্ঞানী দলের একজন, বিজ্ঞানী জন হায়েস চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, তিতা মানেই বিষাক্ত নয়, তিতা মানেই সব সময় খারাপ কিছু নয়, তিতা বলেই কোন কিছুকে এড়িয়ে চলা ঠিক নয়। জিন ভিন্নতার কারণে রাসায়নিক পদার্থ, ক্যাফেইন, কুইনাইন ইত্যাদির তেঁতো স্বাদ শক্তিবর্ধক পানীয়তে থাকলেও মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখায়।

অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা আর ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা এক সাথে প্রায় চার লাখ মানুষের দিনে কয়বার চা বা কফি পান করেন, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। যে মানুষদের জিনগত স্কোর বেশি, তারা ক্যাফেইনের তেঁতো সনাক্ত করতে বাকিদের চেয়ে শতকরা বিশ ভাগ বেশি পারঙ্গম। এরা কফিপ্রেমিক হন। দিনে কমপক্ষে চার কাপ কফি পান না করলে চলে না।

গবেষকরা দেখেছেন, জিনগত স্কোর যাদের কম, তারা তেঁতো স্বাদের পানীয় এড়িয়ে চলেন। মাঝারি মানের যারা, তারা চান পছন্দ করেন। চা প্রেমিকরা কুইনাইন ভালবাসেন না স্বাভাবিক ভাবেই। এই মত দিয়েছেন শিকাগোর নর্থওয়েস্টার্ণ য়্যুনিভার্সিটি ফেইনবার্গ স্কুল অব মেডিসিনের পুষ্টি ও জিন বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ম্যারেলিন সি. কর্ণেলিস। স্বাদের জিন নির্ধারণ করে কতটা ক্যাফেইন সে ভাঙ্গবে, সেই হিসেব মতো ক্যাফেইন গ্রহণ করতে বলে মস্তিষ্ক।

জিন কতটা তেঁতো নিতে পারবে, এই হিসেব সহজ করে দিচ্ছে অন্য হিসেব। জিনের তেঁতো স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ানো যদি যায়, তেঁতো ঔষুধ খাওয়া কোন ব্যাপার হবে না আশা করি। তেঁতোজয়ের যুদ্ধ-ই কি নির্ধারণ করবে জিহ্বার আগামী? দেখা যাক্।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন