শেষ রক্ষা হলো না?
বড় দলগুলোতে কোন্দল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ কোন্দল নেতৃত্বের কোন্দল, ক্ষমতার কোন্দল, এমপি হতে চাওয়ার কোন্দল, মন্ত্রী হওয়ার আকাঙ্খার কোন্দল। তবে এবার নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বড় দুই দলেই কোন্দলের যে তীব্র ও সহিংস প্রকাশ ঘটেছে, তা নজিরবিহীন।
দলীয় কোন্দল অনেক সময় দলের জন্য বিপদজনক। বিরোধী দলের প্রার্থীর চেয়ে নিজ দলের প্রতিপক্ষ অনেক বেশি ক্ষতি করতে পারেন। অনেক বিদ্রোহী প্রার্থীই দলের প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাই প্রতিপক্ষের সাথে লড়াইয়ে নামার আগে ঘর সামলানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে ২০১৪ সালে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়ায় গণতন্ত্র চাপা পড়ে থাকায় এবার বড় দুই দলেই মনোনয়ন প্রত্যাশীদের লম্বা লাইন পড়ে যায়। এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সুবাদে সবাই লাইনে আগে যাওয়ার চেষ্টায় মরিয়া। ৩০০ আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন ৪ হাজার ২৩ জন।
স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা দলের মনোনয়ন পাবেন না, এটা আগেই জানিয়ে না দিলে এ সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি হতে পারতো। তারপরও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের এমন বিপুল স্রোতে হকচকিয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। তারা নানাভাবে বিদ্রোহীদের সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন।
বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের হুমকি আগেই দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই হুমকিকে আওয়ামী লীগাররা ভয় পান বলে মনে হয় না। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, জিতে আসতে পারলে আবার দলে ঠাঁই পাবেন তারা। দশম সংসদের স্বতন্ত্র সাংসদ হাজী সেলিম এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন।
তাছাড়া দল ক্ষমতায় আসতে না পারলে কী অবস্থা হতে পারে, তার ভয়াবহ চিত্র এঁকে বিদ্রোহীদের ভয় দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাতেও তারাও ভয় পাবেন বলে মনে হয় না। কারণ ১০ বছর ধরে দল ক্ষমতায় থাকলেও স্থানীয় এমপিদের দাপটে যারা কোণঠাসা ছিলেন, কিছুই পাননি; তারা এখন সেই এমপিকে হারাতে মরিয়া।
দল ২৯৯ আসনে জিতুক, তার আসন ছাড়া; এমন অনেক আওয়ামী লীগার এখন দেশজুড়ে। শেষ অস্ত্র হিসেবে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা মনোনয়নবঞ্চিতদের কাছে চিঠি লিখেছেন। তিনি মনোনয়ন দিতে না পারায় তাদের কাছে 'দুঃখপ্রকাশ' করেছেন। মহাজোট প্রার্থীকে জয়ী করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, 'আপনাদের ত্যাগ, শ্রম ও আন্তরিকতা সবকিছুই আমার বিবেচনায় আছে।'
শেখ হাসিনার চিঠিতে বলা হয়েছে, মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের সুচিন্তিত মতামত, তৃণমূল নেতাদের পরামর্শ, প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এবং মাঠ পর্যায়ের একাধিক নিবিড় জরিপের ফলাফল পর্যালোচনা করে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে জরিপের ফলাফল এবং তৃণমূল নেতাদের পরামর্শে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে, এমন দাবি মনোনয়নবঞ্চিতদের অনেকেই বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না। তবুও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে শেখ হাসিনাই শেষ কথা। তার 'দুঃখ প্রকাশ' করে লেখা চিঠি বঞ্চিতদের মন গলাতে পারে কিনা, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো কয়েকদিন।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রির ধুম দেখে যারা চমকে গিয়েছিলেন, তাদের চমকের বাকি ছিল। ১০ বছর নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা দলটির ৪ হাজার ৫৮০ জন মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। এই বিপুলসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সামাল দিতে নানা কৌশল নেয় বিএনপি।
প্রথমে ৩০০ আসনের জন্য ৮০০ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এটা ছিল দলের কৌশল। প্রথমত যাতে নানা কারণে মনোনয়ন বাতিল হলেও বিকল্প থাকে। দ্বিতীয়ত যাতে বিদ্রোহীরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করার সুযোগ না পায়। কৌশলটা ভালোই খেলেছিল বিএনপি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুই মামলায় ১৭ বছরের দণ্ড নিয়ে কারাগারে আছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একাধিক মামলায় দণ্ড নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে আছেন। প্রায় এক যুগ তারা ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে মামলা, হামলায় দলটি বিপর্যস্ত। সব মিলিয়ে তাদের অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ ও মরিয়া মনে হচ্ছিল।
মনোনয়ন প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় লন্ডন থেকে তারেক রহমানও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এতদিন সব ভালোই চলছিল। কিন্তু শেষ সময় এসে মনোনয়নবঞ্চিতদের সহিংস বিক্ষোভে বোঝা গেল, অন্তর্কোন্দলের ঘূণ অনেকটাই কেটে রেখেছে দলের ভিত।
শেষ মুহুর্তে এসে জ্বলে উঠেছে ছাইচাপা আগুন। শনিবার দিনভর বিক্ষোভ হয় নয়াপল্টন আর গুলশানে। নয়াপল্টনে দফায় দফায় তালা ঝুলিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা। রাতে গুলশানে ব্যাপক বিক্ষোভ ও ভাংচুর করে মনোনয়নবঞ্চিতদের সমর্থকরা।
রাত ৩টায় মির্জা ফখরুল বেরোনোর সময়ও বিক্ষুব্ধরা তার গাড়ি ঘিরে ধরে। রোববার এই লেখা যখন লিখছি, তখনও বিক্ষোভ চলছিল। বিক্ষুব্ধদের অনেকেই দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ আনেন। মুন্সীগঞ্জে বিএনপি মনোনীত শাহ মোয়াজ্জেমের গাড়িবহরে হামলা চালায় বঞ্চিতরা।
বিদ্রোহের আগুনে জ্বলছে দুই দলের ঘরেই। সামাল দেয়ার চেষ্টা চলছে। নির্বাচনের বাকি তিন সপ্তাহ। এরমধ্যে কোন দল কতটা সাফল্যের সাথে কোন্দল সামাল দিতে পারবে, তার ওপরই নির্ভর করছে চূড়ান্ত সাফল্য।
এইচআর/জেআইএম