ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচন হচ্ছে এই মুহূর্তে এটাই সবচে বড় অর্জন

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ০২:০০ পিএম, ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশে একটি জাতীয় নির্বাচন আর মাত্র ২৬ দিন পরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অনেক ঘোলা জল পেরিয়ে শেষাবধি দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এমনকি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নয়, সেই জামায়াতে ইসলামীও বিএনপি’র প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোকে এই নির্বাচন বহুমুখী বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রথমতঃ নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে একটি দলীয় সরকারের অধীনে, যা সাধারণতঃ অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হয়ে থাকে। নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা পরীক্ষায়ও এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরই মধ্যে গত দশ বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ক্ষমতায় গেলেও আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবে না। বরং তারা একটি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে।

 খোলাসা করে না বললেও তারা বর্তমান ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ চেয়ে কোথাও ভিন্নতর হবে সেরকম কোনো ইঙ্গিত এখনও দেয়নি। ফলে আমরা ধরেই নিতে পারি যে, খুউব বড় কোনো ব্যবধান ভবিষ্যতের নির্বাচনকালীন সরকারে আমরা দেখতে পাবো না। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যে নির্বাচনী দায়িত্ব এই মুহূর্তে পালন করছে তাই-ই বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্বাচনকালীন সরকারের ‘আদর্শ’ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

দ্বিতীয়তঃ এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হবে এবং এতোদিন যারা শেখ হাসিনার সরকারকে কর্তৃত্বপরায়ণ কিংবা ‘স্বৈরাচারী’ বলে গাল দিতেন তারা হয়তো তাদের ভুলটিও বুঝতে পারবেন। কিন্তু একথাও সত্য যে, এই নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের পরাজয় হয় তাহলে সেটা হবে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ আর আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে সেটা হবে ‘কারচুপির নির্বাচনে গণতন্ত্রের পরাজয়’- আমাদের এই বিশ্লেষণের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।

বিএনপি তার গত দশ বছরের আন্দোলনের ব্যর্থতা দলটিকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল যেখান থেকে দলটির ঘুরে দাঁড়ানো মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের পরিবার যখন তারই গড়া দলটিকে নিজস্ব সম্পত্তি মনে করে একে যথেচ্ছভাবে (রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত) ব্যবহার শুরু করে তখন এর বিপুল সমর্থকগোষ্ঠীর জন্য তা দুঃখজনক পরিণতি ডেকে আনে। অনেকেই তখন এই বলে দলটিকে সতর্ক করেছিল যে, কোনো ভাবেই বিএনপি’র রাজনৈতিক ধস ঠেকানো যাবে না, যদি না দলটি বাংলাদেশের মূল গণতান্ত্রিক চেতনা তথা মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে মূল্যায়ন না করে।

২০০১ সালে বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পরও চিহ্নিত ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদেরকে মন্ত্রী করা এবং দেশের ভেতর ধর্মবাদী শক্তিকে অন্যায্য ও অন্যায়রকম প্রশ্রয় দিয়ে দেশকে ধর্মাশ্রয়ী বিরুদ্ধশক্তিতে পরিণত করা ছাড়াও হাওয়া ভবন গঠন করে দেশকে যথেচ্ছ লুটপাট এই দলটির সমর্থকগোষ্ঠীকেও বিরূপ করে তুলেছিল দলটির প্রতি। যে কারণে ১/১১-র আমলে আমরা সংস্কারবাদীদের দেখতে পাই যারা বিএনপি’র নেতৃত্বে একটি পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের সংস্কারবাদীরা কেবল শেখ হাসিনার বিরোধীতাই করেছিল, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বিসর্জন দিতে চেয়েছে বলে জানা যায় না, এমনকি তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী বা গণতান্ত্রিক চেতনা-বিচ্যুতও বলা যাবে না। কিন্তু বিএনপি সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না কারণ ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণের পরও দলটি তার মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী রাজাকার-সঙ্গীদের ত্যাগতো দূরের কথা যখন গোটা দেশ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে তখনও বিএনপি তাদের পক্ষ নিয়ে রাজনীতি করেছে এবং শেষ পর্যন্ত দলটি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বয়কট ও প্রতিহত করতে গিয়ে প্রবল রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়।

 এই মুহূর্তে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ করে জিয়া পরিবার থেকে প্রায় বিচ্যুত অবস্থায় পড়ে ড. কামাল হোসেনের মতো রাজনীতিতে প্রায় শূন্য জনপ্রিয় ১/১১-র চরমতম সমর্থক নেতাকে নিজেদের নেতা করে সরকারের সঙ্গে একটি বোঝাপড়ার মাধ্যমে নির্বাচনে যেতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছে। নাহলে দলটির অস্তিত্ব রক্ষাই সম্ভব হতো না এবং কোনো ভাবেই দলটির ভাঙন রোধ করা যেতো কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। বিএনপি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে এই নির্বাচনে অংশ নিলেও একথা অনস্বীকার্য যে, বিএনপি’র অংশগ্রহণের ফলে এই নির্বাচন ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে এবং দেশে-বিদেশে এই নির্বাচন নিয়ে আশাবাদও তৈরি হয়েছে।

অপরদিকে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে পুরোনো এবং পর পর দু’বার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পর দলটির ভেতর একটি ‘আয়েসি’ ভাব চলে এসেছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি আওয়ামী-বিরোধী প্ল্যাটফরম গঠন করে নির্বাচনের মাঠে নেমে এসেছে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে দলটি কানে পানি ঢুকতে শুরু করেছে যে, আসন্ন নির্বাচনে বিজয়লাভ ২০১৪-র ৫ জানুয়ারির মতো সহজতো হবেই না, বরং নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জয়লাভ বেশ কঠিনই হবে।

দু’বারের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার একটি নেতিবাচক প্রভাব ভোটারদের মনে থাকলেও দেশের ভেতর আওয়ামী লীগ যে উন্নয়ন ঘটিয়েছে এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক ভাবে দলটি ও দলটির প্রধান নেতা শেখ হাসিনা যে প্রভাব-বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তাতে ভোটে বিজয়লাভ খুউব কঠিন নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল হিসেবে মাঠে প্রভাব বিস্তারে বিএনপি’র ব্যর্থতা আওয়ামী লীগকে কিঞ্চিত সুবিধা দিয়েছে সন্দেহ নেই।

দশ বছর যাবৎ কোনো আন্দোলনই জমাতে না পারা এবং পুলিশ-প্রশাসনের চাপে এলাকাছাড়া হওয়া বিএনপি নেতৃত্ব এই অল্প সময়ে ভোটের মাঠে বড় ধরনের কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে তারা আওয়ামী-বিরোধী ভোটের ফায়দা তুলতে সক্ষম হতো যদি না নেতৃত্বের সেই ক্যারিশমা থাকতো। এই মুহূর্তে বিএনপি নেতৃত্বের সেরকম কোনো ক্যারিশমা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, একই সঙ্গে ভোটের ময়দানে জোয়ার তোলার মতো কোনো পরিস্থিতিও তারা তৈরি করতে পারেননি।

বেগম জিয়ার কারাদণ্ড লাভ ও নির্বাচনে অযোগ্য হওয়াকে যতোই বিএনপি গণমানুষকে জাগিয়ে তোলার কাজে ব্যবহার করতে চাক না কেন, মানুষ আসলে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করে যে, বেগম জিয়া দুর্নীতির মাধ্যমে এতিমের টাকাকে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেখেছিলেন। হয়তো তারা একই সঙ্গে একথাও মনে করে যে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতিও সমান ভাবে নিন্দনীয় কিন্তু সে কারণে বেগম জিয়াকে তারা মাফ করে দেবেন বলে মনে হয় না।

সর্বোপরি ও সর্বশেষ নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়েও বিএনপি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না। বিশেষ করে যাদের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে বিএনপি স্পষ্ট করে তুলতে পারেনি মানুষের কাছে। ফলে নির্বাচনের মাঠে এই মুহূর্তে বিএনপি’র অবস্থান এখনও বেশ সাদামাটা এবং জোয়ারহীন।

কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষেই কি জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে? এরকমটিও ভাববার কোনোই কারণ নেই। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মাঠে আছে বটে, সেদিক দিয়ে এগিয়ে আছে দলটি। সর্বোপরি শেখ হাসিনার মতো বরেণ্য ও কার্যকর নেতৃত্ব আছেন যাকে তার শত্রুরাও মনে করেন যোগ্য নেতা, ফলে সাধারণ মানুষ একজন নেতাকে দেখতে পাচ্ছেন যার দলকে ভোট দিলে তিনিই প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ চালাবেন। বিএনপি তথা ঐক্যজোটের ক্ষেত্রে এমন কাউকে তারা নেতা হিসেবে প্রতীয়মান করতে পারছেন না যার ভরসায় মানুষে ভোট দেবে এবং দলকে বিজয়ী করে তার নেতৃত্বে সরকার গঠন করার স্বপ্ন দেখতে পারেন।

ড. কামাল ইতোমধ্যেই এই নেতৃত্বের দৌড় থেকে ছিটকে পড়েছেন। এমনকি নির্বাচনে বিএনপি’র জন্য ভোট চাওয়ার ক্ষেত্রেও ড. কামালের পক্ষে মাঠে নামাটা বেশ লজ্জার হবে কারণ তাহলে তাকে জামায়াতের জন্যও ভোট চাইতে হবে, কারণ জামায়াতও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে। ফলে এই মুহূর্তে বিএনপি একথা জোর গলায় বলতে পারছে না যে, কাকে তারা প্রধানমন্ত্রী করবেন বা কার নেতৃত্বে দেশ চালানোর জন্য তারা ভোট চাইছেন। মানুষ এতে কার্যতঃ বিভ্রান্ত এবং সত্যিকার অর্থেই দ্বিধান্বিত।

একজন কট্টর বিএনপি সমর্থকের পক্ষেও এরকম অনিশ্চিত অবস্থায় ভোটের মাঠে নেমে প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালানো অসম্ভব। কারণ তিনি একথা নিশ্চিত ভাবেই জানেন যে, ভোটে বিজয়ী হয়ে বেগম জিয়াকে মুক্ত করা কিংবা তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর তাদেরকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে এবং সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের অনেক ব্যত্যয় ঘটাতে হবে।

আর যারা আজকে বিএনপি’র জন্য জীবনবাজি রেখে দলটিকে নির্বাচনের মাঠে টিকিয়ে রাখছেন সেইসব বিএনপি-নেতাই কি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর জিয়া পরিবারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে রাজি হবেন? ফলে বহুবিধ প্রশ্নাদি থেকেই যাচ্ছে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।

তবে সব প্রশ্নের উত্তর আমরা পাবো এবং সে সময়ও একেবারে এগিয়ে আসছে দ্রুতই। এই মুহূর্তে দেশের দুই প্রধান দলের নির্বাচনী মাঠে কার কি অবস্থা সে বিষয়ে সামান্য বিশ্লেষণ করা গেল, বাকিটা অবশ্যই ভোটারদের ব্যাপার। নির্বাচন হচ্ছে, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হচ্ছে এটাই বাংলাদেশের এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় অর্জন।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/এমকেএইচ

আরও পড়ুন