ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মনোনয়নও মামা বাড়ির আবদার!

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ১০:১৬ এএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮

ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি মামা-চাচা থাকলে নাকি অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়। নিজের জীবনে এর কোনো প্রমাণ পাইনি। আমার মামাও শিক্ষক, চাচাও শিক্ষক। তাদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি, কিন্তু কোনো অন্যায় সুবিধা পাইনি। তবে 'মামা বাড়ির আবদার' বলেও একটা কথা আছে। সেই সুবিধা পেয়েছি ষোলো আনা।

ছেলেবেলায় পরীক্ষা শেষ হলে বা কোনো ছুটিছাটা পেলেই আমরা মামা বাড়ি বেড়াতে যেতাম। মামা বাড়ি মানেই অবাধ স্বাধীনতা, যা ইচ্ছা তাই করা যেতো। পড়াশোনার কোনো চাপ নেই। দাউদকান্দির রঘুনাথপুরের মামা বাড়িতেই আমার জন্ম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়টাও আমরা মামা বাড়িতেই কাটিয়েছি। রঘুনাথপুর পুরো গ্রামটাই যেন আমার মামা বাড়ি।

হাঁটতে হাঁটতে কোনো বাড়িগে গেলেই, 'ও তুই শাহেদার পোলা' এ কথা বলেই জুটতো বাড়তি সমাদর। পিঠা, চিড়া, মুড়ি, গুড়, গাছের ফল কিছু না কিছু জুটতোই। ক্ষেতে হাঁটতে গেলেও কেউ তুলে দিতো ক্ষিরা, কেউবা কেটে দিতো বাঙ্গি বা তরমুজ। নিজের বাড়িতে যে কাজ করা ছিল মহা অন্যায়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ; মামা বাড়িতে সেগুলো করা যেতো। মামা, খালা, নানা কেউ না কেউ বাঁচিয়ে দিতেন। মামা বাড়ির আবদার মেটানো ছেলেবেলার সেই দিনগুলো এখনও স্মৃতিকাতর করে।

মামা বাড়ির সেই আবদার যে রাজনীতিতেও প্রযোজ্য তা বুঝতে পারিনি আগে। বুঝলাম পটুয়াখালী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেখে। আসনটি আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এ আসনের সাংসদ আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন। ১৯৯১ সালের পর থেকে চারবার তিনি এ আসনের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আ খ ম জাহাঙ্গীর ১৯৯৬ সালে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু ১/১১এর সময় সংস্কারপন্থি হওয়ার অপরাধে ২০০৮ সালে তিনি মনোনয়ন পাননি। মনোনয়নের লটারি জিতে এমপি হয়ে যান গোলাম মাওলা রনি।

নানান বিতর্কে জড়িয়ে ২০১৪ সালে রনি মনোনয়ন পাননি। আবার দৃশ্যপটে আসেন আ খ ম জাহাঙ্গীর। এবার মনোনয়ন চেয়েছিলেন বর্তমান সাংসদ আ খ ম জাহাঙ্গীর, সাবেক সাংসদ গোলাম মাওলা রনি। আওয়ামী লীগের এবারের যে প্রবণতা তাতে আ খ ম জাহাঙ্গীরেররই মনোনয়ন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি পাননি, পাননি সাবেক সাংসদ রনিও। মনোনয়নবঞ্চিত রনি তো ডিগবাজি দিয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষ পেয়ে গেছেন। তাহলে মনোনয়ন কে পেলেন?

যিনি পেয়েছেন, তাকে কেউ চেনেন না। স্থানীয় বা জাতীয় রাজনীতিতে তার কোনো অবদান নেই। তিনি বড় কোনো ব্যবসায়ী বা তারকা ক্রিকেটারও নন। তিনি সাধারণ চাকরিজীবী ছিলেন। কয়েকদিন আগে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। জীবনে কোনোদিন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে ছিলেন না।

 

পটুয়াখালী-৩ আওয়ামী লীগের ২০০ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায়ও তার নাম থাকবে না। তাহলে কোন যোগ্যতায় এস এম শাহজাদা সাজু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন? তার একটাই যোগ্যতা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা তার মামা। আওয়ামী লীগের মনোনয়নও তাহলে মামা বাড়ির আবদারে মেলে!

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাগিনা হলেই তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না, এমন কোনো কথা নেই। তিনি ঋণখেলাপী নন, তিনি দেউলিয়া নন, মানসিকভাকে অপ্রকৃতিস্থ নন, দণ্ডিতও নন। তাই আইনগতভাবে নির্বাচন করতে তার কোনো বাধা নেই। তবে আইনের বাইরেও নীতি-নৈতিকতা বলে কথা আছে। যেমন ২০১৪ সালের নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ হলেও এর নৈতিক মান উচ্চ নয়। সিইসির ভাগিনা না হলে কি এস এম শাহজাদা কোনোদিন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতেন?

নুরুল হুদার সিইসিগিরি শেষ হওয়ার পর কি তিনি আর কোনোদিন মনোনয়ন পাবেন? ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক আকরাম খানের ভাতিজা তামিম ইকবাল জাতীয় দলের ওপেনার। তিনি কিন্তু চাচার পরিচয়ে খেলেন না, খেলেন নিজের যোগ্যতায়। তামিম ইকবাল বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান।

তারপরও একটু খারাপ করলেই তাকে 'ভাতিজা কোটা'র গালি শুনতে হয়। খ ম জাহাঙ্গীর যদি সিইসির ভাগিনা হতেন, তাহলে কোনো কথা ছিল না বা এস এম শাহজাদা যদি পটুয়াখালী আওয়ামী লীগের সভাপতি হতেন, তাহলেও কোনো কথা ছিল না। কিন্তু তার একমাত্র যোগ্যতা, সিইসির ভাগিনা, আপত্তি এখানেই। এটা দৃষ্টিকটু।

সাংবিধানিক পদধারীদের অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি সমান আচরণ করার শপথ নিতে হয়। আর সিইসিকে নিরপেক্ষ থাকার চরম পরীক্ষা দিতে হবে। কারণ তিনি হলেন রেফারি। আর রেফারির ভাগিনা যদি কোনো যোগ্যতা না থাকার পরও খেলার সুযোগ পেয়ে যান, তখনই প্রশ্ন ওঠে। নির্বাচন কমিশন কি পটুয়াখালী-৩ আসনে নিরপেক্ষ থাকতে পারবে? এমনকি এস এম শাহজাদা যদি সুষ্ঠু নির্বাচনেও জয় পান, তাহলেও কিন্তু প্রশ্ন উঠবে।

কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত বলেও একটা কথা আছে। উচ্চ আদালতের বিচারকদের আমরা মাঝে মধ্যে বিচারকাজে 'বিব্রত' হতে দেখি। যদি বাদী বা আসামীপক্ষের কারো সাথে বিচারকের ব্যক্তিগত কোনো সম্পৃক্ততা থাকলে, যদি বিচারক মনে করেন, তিনি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে আচরণ করতে পারবেন না; তাহলে তিনি বিব্রত হতে পারেন।

শুধু বিচারক নন, এইটুকু নৈতিকতা সবার কাছেই কাম্য। সিইসির ভাগিনা যদি সিটিং এমপি বা আওয়ামী লীগের বড় নেতাও হতেন; তাও সিইসি তাকে অন্তত এবার নির্বাচন করা থেকে বিরত রাখতে পারতেন। এস এম শাহজাদাও মামার সম্মান রক্ষার্থে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারতেন।

এস এম শাহাজাদার কাছ থেকে আমরা এই উচ্চ নৈতিকতা আশা করি না। আর তিনি কোনো শপথও নেননি। কিন্তু শপথ নেয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছ থেকে আমরা আরো উচ্চ নৈতিকতা আশা করেছিলাম। কিন্তু তিনি তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ভাগিনার প্রতি অনুরাগের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন নি।

অনেকে বলছেন, সিইসি তো ভাগিনাকে মনোনয়ন দেননি, দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু কাজটা আওয়ামী লীগ ভালো করেনি। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই কিছু পাওয়ার আশায় সিইসির ভাগিনাকে মনোনয়ন দিয়েছে। এখন সিইসি কি আওয়ামী লীগের এই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন?

এই পুরো ঘটনায় একটাই আশার আলো। কথা আছে, 'মামা-ভাগিনা যেখানে আপদ নাই সেখানে'। এখন সিইসি নুরুল হুদা আর তার ভাগিনা এস এম শাহজাদা মিলে যদি জাতিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারেন, তাহলেই স্বস্তি।

provas

এইচআর/এমকেএইচ

আরও পড়ুন