নবান্নের সময়
নভেম্বর মাসের দিকে আমরা সবাই থাকতাম দারুণ ব্যস্ত। বার্ষিক পরীক্ষা। অপেক্ষা শুধু পরীক্ষা শেষের। সদরঘাটে যেয়ে মহা আনন্দে চড়ে বসতাম 'গাজী' লঞ্চে। সরষে রঙের গাজীতে দোতলার কেবিন যেন ছিল এক স্বর্গ। কেবিনের দোতলা বিছানাতে কে উপরে ঘুমোবে তাই নিয়ে চলতো যুদ্ধ। সবগুলো কেবিনের বাইরে খোলা বারান্দা। সাদা রঙের কিছু ইজি চেয়ার পাতা। বাবা মায়ের সাথে বসে, ছোট দু বোনকে নিয়ে কেকটা পাল তোলা নৌকো দেখলো তার প্রতিযোগিতা।
সূর্যাস্তের সময়টা কেন জানি মনটা আমার বিষণ্ণ হয়ে আসতো। কেবিনের ভিতরের দিকে ছিল খাবারের হল। আতপ চালের গরম ভাত, ঝোল ইলিশ, সদ্য ভাঁজা সবজি আর মুগ ডালের স্বাদটা এখনো জিভে লেগে আছে। লঞ্চ থামত চাঁদপুর, ঝালকাঠি ... হয়ে খুলনাতে। রূপসা নদীর তীরে। সেখান থেকে আরেকটা ছোট লঞ্চে উঠে চিত্রা নদীর পাড়ে নড়াইল।
সে সময় ছিল ধান কেটে ঘরে আনার সময়। নবান্নের সময়। নানাবাড়ির চারদিকে উৎসব উৎসব ভাব। বড় বড় খড়ের গাদা। ঢেঁকিতে ধান ভানা হচ্ছে। বাংলো ঘরের উঠোনে দস্তর বিছিয়ে সব মা খালাদের গল্প। সে সময় গ্রামের বাড়িতে কোন বিদ্যুৎ ছিল না। রাতে হ্যাজাক জ্বালিয়ে চলতো পালা গানের পালা।
সকালে খেজুরের রস আসতো। তা জ্বাল দিয়ে আতপ চালের 'রসের পায়েস' তৈরি হতো। ভাঁজা পিঠে, রুটি পিঠে, হাঁসের মাংশ দিয়ে শুরু হতো দিন। পিপাসা লাগলেই ডাবের ঠাণ্ডা পানি। সব মামাত-খালাত ভাই বোনদের সাথে দুরন্ত ছুটে বেড়ানো, বিলের দিকে মাছ ধরা, শালুক কুড়ানো, ঘুড়ির সুতোই পাল্লা...কি দিনই না ছিল।
এ সময় গ্রামে না গেলে মতিঝিল কলোনিতে হালকা ঠাণ্ডার রাতে আলো জ্বালিয়ে খেলতাম ব্যাডমিন্টন। বিকেলে বাসার সামনের জাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সব বন্ধু মিলে তুমুল আড্ডা হতো। আমরা সবাই মিলে বনভোজনের ফন্দি আঁটতাম। আড্ডার মাঝে মাঝে কি চোখ চলে যেত এদিক ওদিক? আমরা মজা করে বলতাম- ফিল্ডিং।
উঠতি বয়সে মেডিকেল কলেজে এ সময়টাতে বিকেলে 'ক্যাফে রোজে' আড্ডা বসতো। পনের বিশ জন বসে সারা দুনিয়ার গল্পসল্প, আর রসালো গসিপগুলো নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠত। পরীক্ষা পেছাবে কিনা, অটো ভেকেশন হবে কিনা এ নিয়ে চলতো জল্পনা কল্পনা। সবারই চোখ কোন না কোন ভাবে থির হতো রাস্তার ওপারে- কান্তা ছাত্রীনিবাসের দিকে।
আজ অনেক বছর পরে, আমার নতুন আবাসে এ সময়টা এদেশী নবান্নের। থাঙ্কস গিভিংয়ের পালা শেষ। পরিবার পরিজনদের সাথে এদেশী নবান্ন করে ঘরে ফিরেছি। আজ বিকেলে এক পশলা বৃষ্টির পর শীতের ছোঁয়ায় বসেছি দীঘির পাড়ে। হঠাৎ করে নাড়ার ঘ্রাণ পেলাম।
নড়াইলের পাশ ঘেঁষে চিত্রা নদীর পাড়ে কাঁশবনের কথা মনে পড়ছে। পুরোনো ঢাকার অচেনা এক গলিতে রিক্সার পাশ কেটে চলে যাওয়া শীতের বিকেলের কথা মনে পড়ছে। মাধবদীর নবান্নের উৎসবটা বড় মনে পড়ছে। দীঘির পারে সন্ধ্যা নামছে। হালকা কুয়াশা দীঘির বুকে। হেমন্ত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
"হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে;
এ রকম অনেক হেমন্ত ফুরায়েছে
সময়ের কুয়াশায়ে।"
(জীবনানন্দ)
লেখক : ডা. বিএম আতিকুজ্জামান, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি।
এইচআর/আরআইপি