ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কেন জরুরি

এরশাদুল আলম প্রিন্স | প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ২৭ নভেম্বর ২০১৮

বিএনপিতো নির্বাচনে এলো। কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন? ইতিমধ্যে আদালত তার বিরুদ্ধে দুইটি মামলার রায় দিয়েছে এবং এর মধ্যে একটি আপিলের রায়। গত মাসেই তার বিরুদ্ধে দুটি মামলার রায় হলো। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আদালত তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আপিলের রায়ে সাজার মেয়াদ ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করা হয়।

সব মিলিয়ে বর্তমানে তিনি ১৭ বছরের এক দণ্ডিত আসামি। তাই আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খালেদা জিয়া কি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন নাকি পারবেন না। তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারার বা না পারার আইনগত বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ আছে।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার বিচারের রায় হয়নি। কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনে আগে এবার তাদের দুজনেরই সাজা হয়েছে। ফলে বিএনপির আগের দাবির সাথে আরো দুই দফা দাবি যুক্ত হলো। সব দাবি দাওয়ার সমন্বয় করে তারা ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে সরকারের কাছে ৭ দফা দাবি পেশ করলো। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো খালেদা জিয়ার মুক্তি। কিন্তু সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি বা অন্য কোনো দাবি মেনে নেয়নি।

লক্ষ্যণীয়, ২০১৪ সালে খালেদা জিয়া বাইরে থাকাতেও বিএনপি নির্বাচনে আসেনি, কিন্তু এবার তাকে কারাগারে রেখেই বিএনপি নির্বাচনে আসতে বাধ্য হচ্ছে। কথায় বলে, কাচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে টাস টাস। বিএনপিকে সেই নির্বাচনে আসতেই হলো, কিন্তু অনেক বদনামের ভাগি হয়ে, অনেক কিছু হারিয়ে, অনেক জল ঘোলা করে। তবে রাজনীতিতে অনেক কিছু হারিয়েও আবার অনেক কিছু অর্জন হয়। বিএনপি যদি গত এক দশকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী দিনের রাজনীতি পরিচালনা করে তবে তা দলের জন্যতো বটেই, দেশের রাজনীতির জন্যও হবে একটি বড় প্রাপ্তি।

বিএনপির নির্বাচনে আসা শুভ লক্ষণ। জনগণ বিএনপির এ সিদ্ধান্তে খুশি। জনগণ ভোট দিতে চায়। বিএনপি নির্বাচনে আসার কথা বলেও আবার ফিরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু সে হুমকি থেকেও তারা সরে এসেছেন। মির্জা ফখরুল বলেছেন যে তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবেন। এটি তাদের আরো শুভ বুদ্ধির পরিচায়ক। কারণ, নির্বাচন থেকে সরে আসার হুমকি থাকলে তাদের প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠে সঠিকভাবে সময়, অর্থ, কৌশল প্রয়োগ করবেন না। ঠিকভাবে প্রচারণাও চালাবেন না। প্রার্থীরা নির্বাচনকে সিরিয়াসলি নেবেন না। কাজেই এ হুমকি-ধামকি থেকে সরে এসে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সেটি জাতিকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এখন সরকারের জন্য সবচেয় বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জাতিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া। আওয়ামী লীগ পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায় বহন করবে না বলেই মনে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেবেন বলেই মনে হয়। এবং কোনো কারণে (যে কারণেই হোক) আওয়ামী লীগ যদি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হয় তবে তা হবে দলটির জন্যে একটি বড় ব্যর্থতা যা আগামী দিনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জন্য নেতিবাচক ফলই বয়ে আনবে। কারণ, সুবিধাবাদী, ধামাধরারা চিরকালই বসন্তের কোকিল। কিন্তু ইতিহাস তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়। ভালো বা মন্দ-যা-ই হোক-ইতিহাস রচনার আগে ভবিষ্যতের দিকে একবার দৃষ্টি দেয়া দরকার। কারণ, ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে।

একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য জাতি অপেক্ষা করছে একদশক ধরে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন সমসুবিধার ভিত্তিতে সবাইকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া। এর মানে এই নয় যে সরকার সবাইকে পাজা কোল করে নির্বাচনে নিয়ে আসবে। কিন্তু আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিহার করতে হবে। এটিই কমিশন তথা সরকারের দায়িত্ব। কে জয়ী হলো কে হলো না সেটি দেখা কমিশন বা সরকারের কাজ নয়। তাই নিয়ন্ত্রণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান আওয়ামী লীগের জন্য হঠকারি হবে। সেটি হলে সংবিধান পরিবর্তন করে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধানের আর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা সরকারের থাকবে না।

এটাও ঠিক যে সরকারতো যেচে নিজের জন্য নির্বাচনকে কঠিন করে তুলবে না। তাই নির্বাচনে সমসুবিধা আদায় করতে হলে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টকে তাদের দাবি পেশ করে যেতে হবে। সরকার তথা নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশলই তাদেরকে অনেকটা সমসুবিধা দিতে পারে। কারণ, আমাদের দেশে রাজনৈতিক সরকারে অধীনে নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সে অভিজ্ঞতা থেকে রাতারাতি ভিন্ন কিছু প্রাপ্তির আশা অমূলক।

সরকার ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি না মানলেও ইতিমধ্যে সরকার তার কথা ও আচরণে অনেকটা সংযত। একাডেমিক্যালি নির্বাচনকালীন সরকার বলতে যা বোঝায় তা আমাদের দেশে এখনও হয়নি। সে রকম আদর্শিক রাজনীতি আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। এর মধ্যেই সরকার যতোটুকু নমনীয় হয়েছে তাই অনেক পাওয়া। তবে, নির্বাচন কমিশন যদি তার সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে এগিয়ে আসে তবে তাতে আমাদের দেশে ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ ধারণাটি আরো সুন্দর হতে পারে। কিন্তু পদ-পদবী হারানো ভয় সবচেয়ে বড় ভয়। কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার পরও যদি এই সরকারই ক্ষমতায় আসে তখন কে তাকে রক্ষা করবে। পদের সাংবিধানিক রক্ষাকবচের চেয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বেশি প্রয়োজন। রাজনৈতিক সরকারে অধীনস্ত সাংবিধানিক পদাধিকারীদের এই বোধটি সবচেছে বেশি জরুরি। এই বোধ যার যতো বেশি তার গদি ততো আরামদায়ক।

কাজেই বাস্তবতা হলো, কমিশন স্বাধীন হতে চাইলেই যে তার পক্ষে রাতারাতি স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব বিষয়টি তেমন নয়। কমিশনের নিজস্ব সচিবালয় থাকলেও সরকারে সহায়তা ছাড়া তার কার্যোদ্ধার সম্ভব না। পুলিশ-প্রশাসন সবই সরকারের হাতে। সংবিধানে আছে সরকার কমিশনকে সাহায্য করবে। কিন্তু কমিশনের সেই সাহায্য চাওয়ার মতো কোমরের জোর আছে কি? বিষয়টি এই সরকার বা এই কমিশনের নয়। আমরা আবদুল আজিজ কমিশন দেখেছি, দেখেছি আবদুল রউফ কমিশনও। কাজেই বিষয়টি হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। সেজন্য যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের প্রয়োজন তাও গড়ে ওঠেনি। তবে কি আমরা হাল ছেড়ে দেব? না।

অবশ্যই না। সংস্কৃতি মানে তো ধারাবাহিক জীবনাচারের ফল। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিও তা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ধারাবাহিক রাজনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তা পরিশীলিত হয়। ভোট আমাদের সেই রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ যার মাধ্যমে আমাদের রাজনীতি ও গণতন্ত্র পরিশীলিত হয়। সমৃদ্ধ হয় আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সেই ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন